শিরোনাম
প্রতিবেদন: দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ
কুমিল্লা, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস): মেহেদী হাসান শুভ কুমিল্লা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী। গত ১৭ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কুমিল্লার কোটবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি। দুই চোখ, বুক-মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছররা গুলির ৫০ এর অধিক স্প্রিন্টার এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। এ ঘটনার পর থেকেই চোখে সবই অস্পষ্ট দেখছেন মেহেদি। গত তিন মাসে কয়েকদফায় অস্ত্রোপাচার করেও স্বাভাবিক হয়নি তার দৃষ্টি। অর্থনৈতিক সঙ্কটে, উন্নত চিকিৎসার অভাবে দিন দিন কমে আসছে মেহেদীর দৃষ্টি শক্তি।
সহপাঠীদের কিছুটা সহযোগিতা পেয়েছেন সত্যি। কিন্তু সন্তানের চোখের চিকিৎসায় মেহেদীর বাবাকে বিক্রি করতে হয়েছে উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম অটোরিকশা।
মেহেদীর দাবি, কোন অনুদান নয়, তার দরকার সরকারি সহযোগিতায় উন্নত চিকিৎসা।
কুমিল্লার লালমাই উপজেলার বেলঘর উত্তর ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামের বাসিন্দা লিটন মিয়ার চার সন্তাানের মধ্যে দ্বিতীয় মেহেদী হাসান শুভ (১৮)। তিনি তার পিতামাতার একমাত্র ছেলে সন্তান। তার মা হাসিনা আক্তার (৩৮) একজন গৃহিণী। বড় বোন লিপি আক্তার (২৩) বিবাহিত। এরপর মেহেদী হাসান। ছোট বোন আশুরা আক্তার মনি (১৬) এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবেন এবং একেবারে ছোট বোন উর্মি আক্তার (১২) ৬ষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী।
মেহেদী জানান, ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসায় আছেন তিনি। ধারাবাহিকভাবে কয়েকদিন পর পর ঢাকায় গিয়ে সেখান থেকে চিকিৎসা করাতে হয়। সামনে পরীক্ষা আছে। কিন্তু এখনও সব ঝাপসা দেখেন। চোখের কাছে নিয়েও বইয়ের লেখা পড়া যায় না। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্যে যে খরচ লাগে তা বহন করা পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়।
মেহেদীর বাবা লিটন মিয়া জানান, ছেলের চোখের চিকিৎসায় শুরুতেই বেচে দিয়েছেন তার উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম অটোরিকশাটি। অটোরিকশা বিক্রির টাকায় প্রথম কয়দিন চিকিৎসা চলেছে। এরপর থেকেই হাত পাততে হয়েছে এদিক ওদিক। একদিকে ছেলের চিকিৎসার খরচ, তিন মেয়ে এক ছেলেসহ ছয় সদস্যের পরিবারের দৈনন্দিন খরচ চালাতে গিয়ে একেবারে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
তিনি বলেন, শুরুতে পলিটেকনিক্যালের ছাত্ররাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে চিকিৎসা বাবদ কিছু সহযোগিতা আমরা পেয়েছি। কিন্তু তা দিয়ে কিছুটা সাহায্য হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সম্ভব হয়নি। তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি সহযোগিতা চান।
লিটন মিয়া জানান, বিভিন্ন হাসপাতালে মেহেদীকে চিকিৎসা করানো হয়েছে। সর্বশেষ ঢাকা গ্রীণ রোডে ভিশন আই হাসপাতালে তাকে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সিদ্দিকুর রহমানের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা করানো হচ্ছে।
চিকিৎসকের বরাত দিয়ে লিটন মিয়া জানান, মেহেদী আগের দৃষ্টি ফিরে পাবে এমন কোন সম্ভাবনা নেই। ডান চোখটি একেবারে নষ্ট হয়েও যেতে পারে। ভালো চিকিৎসা না করালে বাম চোখেরও ক্ষতি বাড়তে পারে।
তিনি বলেন, মেহেদীর দুই চোখে এ পর্যন্ত ৬টি অস্ত্রোপাচার করা হয়েছে। ছররা গুলিতে ডান চোখের প্রায় ৯০ শতাংশ এবং বাম চোখের অন্তত ৫০ শতাংশ অকেজো হয়ে পড়েছে। সরকারি হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা হচ্ছে শুনেছি। কিন্তু যে চিকিৎসকের কাছে ৬টা অপারেশন করেছে, এখন তাকে বাদ দিয়ে যদি অন্য কোথাও যাওয়া হয় তাহলে ছেলের চিকিৎসাটা ব্যাহত হতে পারে।
মেহেদীর চাচা হায়াতুন্নবী জানান, ছোটবেলা থেকেই মেধাবী মেহেদী এসএসসিতেও জিপিএ-৫ পেয়েছিলো। বাড়িতে একটি দোচালা টিনের ঘর ছাড়া তেমন কিছুই নেই তাদের। নানান টানাপোড়েনের মধ্যেও ছেলে মেহেদীর পড়াশুনা নিয়ে বাবা লিটন মিয়ার ছিলো বড় স্বপ্ন। মেধায় অগ্রাধিকার পাবার আন্দোলনে গিয়ে মেহেদী এখন দৃষ্টি হারাতে বসেছে। ছেলেটার ভবিষ্যত যেমন অন্ধকারে প্রায়, তেমনি তার বাবারও স্বপ্ন ভেঙ্গে যেতে বসেছে। একমাত্র সরকারি ভাবে অর্থায়ন করা গেলেই মেহেদীর দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুমিল্লা মহানগর কমিটির আহবায়ক মু আবু রায়হান বলেন, মেহেদীর মত ছেলেরা আমাদের অনুপ্রেরণা। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কিভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়, তারা আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছিল। মেহেদীর মত সকল বিপ্লবীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।