বাসস
  ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৪৭
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩১

উপরের নির্দেশে চিকিৎসা না পেয়ে শহিদ হলেন শুভ

 

প্রতিবেদন: বরুন কুমার দাশ

ঢাকা, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : আমার ছেলের কবরটি যেন স্থায়ী থাকে। সেখানে যেন আর কাউকে দাফন না করা হয়। আমি যেন সারাজীবন আমার সন্তানের কবরটি দেখতে পারি। প্রতিদিন যেন সন্তানের কবরটি দেখে আসতে পারি। আমরা ছেলেটাকে যেন শহিদের মর্যাদা দেওয়া হয়।

রাজধানীর রায়ের বাজারের বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমন কথা বলেন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহিদ আল-আমিন ইসলাম শুভর মা রেণু বেগম। শুভ’র মা রেণু বেগমের বয়স ৪২ বছর। 

রেণু বেগম বলেন, ‘আমার সন্তানকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করতে দশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলাম। আমার সন্তান দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। আমি চাই আমার সন্তানের কবরটি যেন সেখানে স্থায়ী থাকে। সেখানে যেন আর কাউকে দাফন না করে। আমি যেন সারাজীবন আমার সন্তানের কবরটি দেখতে পারি। প্রতিদিন যেন সন্তানের কবরটি দেখে আসতে পারি।’

আল-আমিন ইসলাম শুভ। ১৬ বছরের এই কিশোর গত ১৯ শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চলাকালে ধানমন্ডি-৩ নম্বর রোডে গুলিবিদ্ধ হন। শুভর গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার কাজিরহাট উপজেলার চড় সোনাপুর গ্রামে। 

গুলিটি তার ডান চোখের উপরে লেগে মাথায় বিদ্ধ হয়। ওইদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ’তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। চার ভাইবোনের মধ্যে মেজো ছিলেন শুভ। তিনি ধানমন্ডির একটি গ্যারেজে কাজ করতেন। শুভ’র তিন বছর বয়সে তার বাবা মো. আবুল অন্যত্র বিয়ে করেন। এরপর থেকে তার মা রেণু বেগম সন্তানদের নিয়ে ফুটপাতে পলিথিনে মোড়ানো ঘরে জীবন-যাপন করতেন। গ্যারেজে কাজ করে শুভ মা’কে সহযোগিতা করতেন। সন্তানকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন এই মা। তার চোখের সামনেই গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় ঢলে পড়েছিলেন শুভ।

শুভর মা রেণু বেগম বলেন, শুভর বাবা অন্য আরেক জনকে বিয়ে করার পর আমি সন্তানদের নিয়ে ফুটপাতে পলিথিনে মোড়ানো ঘরে ঘুমাতাম। আমাদের কোনো দিন-রাত ছিল না। শুভর তিন বছর বয়সে ওর বাবা আমাদের ফেলে চলে যায়। যখন একটু বোঝার বয়স হয় তখন থেকে শুভ কাজে নেমে পড়ে। অর্থের অভাবে বেশিদূর পড়াশোনা করাতে পারিনি। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে সে। 

তিনি বলেন, ওর ছোট দুই বোন রয়েছে। তারাও বেশিদূর পড়তে পারেনি। আমিও গ্যারেজে কাজ করতাম। এখনও করি। একদিন শামীম নামে এক ব্যক্তি আমাদের এই দুরাবস্থা দেখে বিয়ের প্রস্তাব দেন। এরপর তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। ওই ঘরে দুই মেয়ে রয়েছে। উনি আমার এই চার সন্তানকে আগলে রেখেছেন সবসময়। কোনো কষ্ট পেতে দেননি। সবাই আমরা ছোট ছোট কাজ করে সংসারের খরচ চালাই।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রেণু বেগম বলেন, গত ১৯শে জুলাই বিকাল চারটার দিকে গুলিবিদ্ধ হয় শুভ। সে ধানমন্ডিতে একটি গ্যারেজে কাজ করতো। জুমার নামাজের পর ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে রাস্তায় নামে। এ সময় মাথার ওপর থেকে একটি হেলিকপ্টার যায়। সেটি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় ঢলে পড়ে যায় আমার সন্তান। 

তিনি বলেন, সেদিন ঘটনার আগে আমি গিয়ে দেখি শুভ গ্যারেজ বন্ধ রেখে ঘুমাচ্ছে। আমি  ভেতরে যেতে যেতে বাবা বাবা বলে ডাকি। তখন শুভ আমাকে বলে, মা ক্ষুধা লাগছে, ভাত আনোনি? আমি বলেছিলাম হ্যাঁ এনেছি। তখন আমার মেয়েকে ওর ভাইয়াকে খাবার দেওয়ার কথা বলি। এ সময় হঠাৎ বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। শুভ খাবার পরে খাবে বলে বাইরে চলে যায়। সেখানে গিয়ে রাস্তায় টিয়ারগ্যাসে অসুস্থ হয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের পার্কিংয়ে বসিয়ে পানির ব্যবস্থা করে দেয়। আমি এর আগে শুভর সঙ্গে রাস্তায় ছিলাম। আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে বলে, ‘মা গ্যাসে অসুস্থ হয়ে পড়বা, বাসায় যাও।’ চারদিকে সে সময় প্রচন্ড গোলাগুলি হচ্ছিল। আমিও তখন বাসায় যাওয়ার জন্য অপর পাশের রাস্তায় চলে যাই। তখন শুভও আমার দিকে আসছিল সেটি আমি দেখতে পাইনি। কিছুক্ষণ পরে পিছন দিকে তাকিয়ে দেখি খালি গায়ে একটি ছেলে রাস্তায় ঢলে পড়ছে। 

আমি চিৎকার দিয়ে বলতে থাকি, কার সন্তান যেন পড়ে যাচ্ছে কেউ একটু ধরো। কাউকে এগিয়ে আসতে না দেখে আমি নিজেই দৌড়ে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি এটি আমারই শুভ। আমি দশ হাতের মতো দূরে ছিলাম। সে একটি সাদা গেঞ্জি পরা ছিল। কিন্তু সেটি খুলে মাথায় দেয়ায় আমি বুঝতে পারিনি সে আমার সন্তান। কাছে গিয়ে যখন দেখি এটি আমার ছেলে তখন চিৎকার দিয়ে তার বুকের ওপর পড়ে যাই। আমার গায়ে থাকা ওড়না দিয়ে ওর মাথাটি বেঁধে দেই। তখন আমি চিৎকার দিলে দু’জন ছাত্র এগিয়ে আসে। সে সময় শুভকে পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে কোনোমতে ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেয়।

শুভ’র মা আরও বলেন, ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসকরা ভর্তি নেবে না। শুভর বিকাল চারটায় গুলি লাগে। তারপর থেকে হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে ছিল। রাত নয়টায় তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। ভোর চারটায় শুভ মারা যায়। পরের দিন ২০ জুলাই সন্ধ্যা সাতটার দিকে শুভর মরদেহ পাই। পরে রাত দশটার দিকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। 

রেণু বেগম বলেন, ঢাকা মেডিকেলে যখন যাই তখন আমাদের কাছে কোনো টাকা ছিল না। সিএনজিচালককে সেটি জানালে তিনি টাকা লাগবে না বলে জানান। সন্তানের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকদের পায়ে ধরার পর ঠেলে বের করে দিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর আবার গিয়ে তাদের হাতে-পায়ে ধরি। এভাবে কয়েকবার বলার পরে চিকিৎসকরা বলেন, ‘আমাদের কিছু করার নেই। এটা উপর থেকে নির্দেশ চিকিৎসা না করার জন্য।’ পরে বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বললে তারা চিকিৎসকদের গিয়ে বলে। বিকাল পাঁচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত রক্তাক্ত অবস্থায় আমার সন্তান বারান্দায় পড়ে ছিল। অনেক হাতে-পায়ে ধরার পর রাত নয়টার সময় একটি অপারেশন করার কথা জানায় ডাক্তাররা। ওইদিন ভোর চারটার দিকে শুভ মারা যায়। 

রেণু বেগম বলেন, আমার সংসারটি শুভই চালাতো। ও ছোটবেলা থেকে বসে থাকতে চাইতো না। আমার সন্তান যখন গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে যায়, তখন ও অজ্ঞান ছিল। কোনো কথা বলতে পারেনি। 

তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে আমি সন্তানদের নিয়ে সংগ্রাম করছি। কখনো কোনো কষ্ট পেতে দেইনি। বর্তমানে ওর সৎ বাবা চা বিক্রি করেন। শুভ একটি মেসে থাকতো আর আমি মেয়েদের নিয়ে একটি ভাড়া বাসায় থাকি। তিনি বলেন, যখন শুভর একটু বোঝার বয়স হয়েছে তখন থেকে আমার কষ্ট ঘুচাতে সে কাজ করা শুরু করে। 

প্রতিবেশি ইসমাইল হোসেনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সব সময়ে ছেলে শুভর জন্যে কান্নাকাটি করেন ওর মা। গত কয়েকদিন হলো ওনার অনেক জ্বর। কাজে যেতে পারছেন না। মাঝে মাঝেই কান্নাকাটি শুরু করেন। কি বলবো বলেন, সান্ত্বনা দেয়ার যে কোন ভাষা নেই।