শিরোনাম
প্রতিবেদন: মো: রোস্তম আলী মণ্ডল
দিনাজপুর, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : দিনাজপুরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে গত ৫ আগস্ট হিলিতে শহিদ হন নবম শ্রেণির মেধাবী শিক্ষার্থী আসাদুজ্জামান নূর সূর্য। দু’ভাইয়ের মধ্যে শহিদ সূর্য ছিল ছোট। তবে, সূর্যকে নিয়েই সব আশা-ভরসা ছিল তার মায়ের। সূর্য হত্যার ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে বিচার দাবি করা হয়েছে।
সম্প্রতি কথা হয় দিনাজপুর জেলার হাকিমপুর উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে শহিদ সূর্যের মা রাজিয়া সুলতানা ও ভাই সুজন মিয়ার সাথে। শহিদ সূর্যের বাড়ি দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের রাজিয়া সুলতানার ছেলে।
সূর্য (১৫) যখন খুব ছোট তখন তার বাবা মজনু মিয়া মারা যান। এরপর থেকে মা রাজিয়া সুলতানা স্থানীয় হাকিমপুর উপজেলার হিলি স্থলবন্দরের পাশে অবস্থিত একটি জুট মিলে কাজ করে দুই ছেলেকে নিয়ে অতিকষ্টে সংসার চালাচ্ছিলেন।
রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘সবাই বলে, আমার সূর্য নাকি মারা যায়নি। সে নাকি সবার মাঝে বেঁচে আছে। কিন্তু, কই কারো মাঝে তো আমার বুকের ধনকে খুঁজে পাই না। গত ৪ আগস্ট সকালে ছেলে বলল, মা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যাচ্ছি। আমি বলেছিলাম, তোমার এসব আন্দোলনে যাওয়ার দরকার নেই। আমরা গরীব মানুষ। আমাদের এসবের কি দরকার। কিন্তু সূর্য তার মাকে সান্তনা দিয়ে, বুঝিয়ে দেশের আন্দোলনরত যুব সমাজের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনে অংশ নেয়। যাবার সময়, মা সূর্যকে বলেছিল, ‘এসব ঝামেলার কাজে যাচ্ছিস, বাবা তুই খুব সাবধানে থাকিস। বেশি গণ্ডগোল বা ঝামেলা দেখলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসিস’।
সূর্য যাবার সময় শেষবারের মতো মাকে বলেছিল, ‘সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে আসবো’। কিন্তু, সেদিন সন্ধা গড়িয়ে রাত হয়ে গেল, আর ছেলে ফিরে এলো না, ফিরল পরের দিন পোড়া লাশ হয়ে।
রাজিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে সূর্য ছিল আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু, গত ৫ আগস্ট ছেলের সঙ্গে পুড়ে গেছে আমার বেঁচে থাকার সব স্বপ্ন ও অনুপ্রেরণা। গত ৪ আগস্টের পর আমার এই জীবনের বেঁচে থাকার আকাশে আর সূর্য উঠেনি। প্রতিদিন মনে হয় সূর্য ডুবে গেছে, আর কখনো উঠবে না। এই ভাবনা আমাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়ায়। রাতে শুইলেও একই চিন্তা ও ভাবনায় ঘুম আসে না। চোখ বন্ধ হলেই সূর্যের মৃত্যুর ছবি ভেসে ওঠে। আচমকা ঘুম থেকে উঠে বসে থাকি। আর কাঁদি। আমার নিকট আত্মীয়-স্বজনেরা এই অবস্থা দেখে আমাকে বলে তুই কিভাবে বাঁচবি।’
তিনি আরো বলেন, আত্মীয়-স্বজন আমাকে বুঝ দেয়, মহান আল্লাহতালা, হয়তো এভাবেই তার মৃত্যু লিখে রেখেছিল। দেশের জন্যে সে প্রাণ দিয়েছে। তাই তোর সন্তানের মৃত্যু শহিদের মৃত্যুর সমান।
সূর্যের মা এসব সান্ত¦নাকে বুকে নিয়েই দিনাতিপাত করছেন। তিনি বলছেন, আর যেন কোন মায়ের কোল খালি না হয়, এটাই তার সবচেয়ে বড় চাওয়া।
শহিদ সূর্যের বড় ভাই মোঃ সুজন মিয়া (২৮)বলেন, আমি আমার ছোট ভাইয়ের এই অকাল মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদেরকে আসামী করে গত ১৯ আগস্ট হাকিমপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছি। মামলার এজাহারে ২৩ জনসহ অজ্ঞাতনামা আরো ১০০ জন আসামী করেছি। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন আসামীকে পুলিশ গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠিয়েছে। আমি আশা করছি, আমার ভাইয়ের হত্যার ন্যায্য বিচার পাবো। এই সরকারের আমলে এই বিচারই আমাদের দাবি।
তিনি বলেন, গত ৯ অক্টোবর আমার ছোট ভাই সূর্যের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়েছে। সেই সাথে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গে ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়। এই হত্যার ঘটনার সাথে জড়িত এজাহার নামীয় আসামী আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক, হাকিমপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ হারুন ও হাকিমপুর পৌরসভার মেয়র জামিল হোসেন চলন্তসহ বেশ কয়েকজন আমাকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে মামলাটি আপোস করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু আমি তাদের প্রস্তাবে রাজি হইনি। আমি ও আমার মা রাজিয়া সুলতানা, আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার দেখতে চাই, এটাই বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের দাবি।
তিনি আরো বলেন, গত ৪ আগস্ট দুপুর আড়াইটায় আন্দোলনত ছাত্রদের ওপর আওয়ামী নেতাকর্মীরা হামলা চালায় ও মারধর করে। তাদের আক্রমণে অন্যান্যরা পালিয়ে যায়। আসামীরা পরিকল্পিত ভাবে, ঘটনাস্থল থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নাফিস, মোস্তাকিম মেহেদী, মহিদুল, বাবু আহমেদ, সূর্য ও নাঈম সহ ৬ জনকে অপহরণ করে আসামী জামিল হোসেন চলন্তর বাড়িতে আটক করে রাখে। চলন্ত তার বাড়ির ভেতরে তৈরিকৃত টর্চার সেলে তাদের শারীরিক নির্যাতন ও মারধর করতে থাকে। আসামীদের মারধর ও নির্যাতনে সূর্য ও নাঈম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এই ঘটনা দেখার পর কৌশলে ঘটনাস্থলে আটক থাকা নাফিস,মোস্তাকিম মেহেদী, বাবু আহমেদ ও মহিদুল পালিয়ে আসে। তারা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে এসে সূর্য ও নাঈমের মৃত্যুর খবর সকলকে জানায়।
পরদিন ৫ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৩ টায় আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যায়। এই খবর পেয়ে আসামী চলন্ত তার বাসার মালামাল সরিয়ে বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে শহিদ সূর্য ও নাঈমের মৃতদেহ পুড়ে বিকৃত হয়ে যায়। বিষয়টি স্থানীয় হাকিমপুর উপজেলা বিএনপি নেতা সাখাওয়াত হোসেন শিল্পীকে অবহিত করা হয়। তিনি হাকিমপুর উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সহায়তায় ওই দিন রাত সাড়ে ১১ টায় আগুন নিভিয়ে চলন্তর বাড়ির ভেতরের টর্চার সেল থেকে তাদের বিকৃত লাশ উদ্ধার করে। ঘটনার সময় পুলিশের কর্মবিরতি থাকায় নিহত দু’জনের লাশের সুরুতহাল ও ময়না তদন্ত করা সম্ভব হয়নি। ফলে ময়না তদন্ত ছাড়াই ওই দু’জনের দাফন সম্পন্ন করা হয়।
পরে মামলা দায়ের হলে তাদের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে সুরতহাল রিপোর্ট ও ময়নাতদন্ত সম্পূর্ণ করা হয়।
প্রতিবেশী ইয়াসমিন আক্তার নামের এক নারী বলেন, গত ৪ আগস্ট সকালে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন সূর্য। তবে, সেদিন আর বাড়ি ফেরেননি তিনি। সারাদিন অপেক্ষার পরেও ছেলে না ফেরায় রাতে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেন তার মা রাজিয়া সুলতানা। কিন্তু, ছেলের সন্ধান পাননি। পরের দিন পৌর মেয়রের পোড়া বাড়ি থেকে সূর্যের দগ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।
শহিদ সূর্যের নামে হাকিমপুর উপজেলায় একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।
এলাকাবাসী বলেন, সূর্য খুব ভালো ছেলে ছিল। তার মা রাজিয়া সুলতানা অনেক কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছিলেন। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে সূর্য শহিদ হন। ছেলের শোকে তার মা আজ পাগল প্রায়। সারাদিন ছেলের ছবি-কাপড় বুকে নিয়ে কাঁদেন।
হাকিমপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শিল্পী বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে সূর্য শহিদ হয়েছেন। আমরা শহিদ সূর্যের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে হাকিমপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ এই হত্যার ঘটনার সাথে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে।’
এদিকে ময়না তদন্তের রিপোর্ট প্রসসঙ্গে তিনি বলেন, শহিদ সূর্য হত্যার ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসবে। আগুনে পুড়ে মৃত্যুর ঘটনায় কিছু টেকনিক্যাল পরীক্ষা নিরীক্ষা রয়েছে। ওইসব বিষয় পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ঢাকা সিআইডি সদর দপ্তরে আলামত প্রেরণ করা হয়েছে। পরীক্ষার প্রাপ্ত তথ্য পাওয়া গেলে, ময়না তদন্ত রিপোর্ট হাকিমপুর থানায় প্রেরণ করা হবে। এরপর জড়িতদের বিরুদ্ধে পুলিশ আদালতে অভিযোগ পত্র পেশ করবে।
জেলার হাকিমপুর থানার অফিসার ইনচার্জ পরিদর্শক মোঃ সুজন মিয়া বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট হাকিমপুরে আসাদুজ্জামান নূর সূর্য (১৫) শহিদ হয়েছেন। এই ঘটনায় শহিদ সূর্যের বড় ভাই সুজন মিয়া বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেছে। ময়না তদন্ত রিপোর্ট পাওয়া গেলে এজাহার নামীয় আসামীসহ তদন্তে প্রাপ্ত এই ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র পেশ করা হবে।
এদিকে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, জেলার হাকিমপুর উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের আসাদুজ্জামান সূর্য বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আগুনে পুড়ে শহিদ হয়েছে। আমি এ জন্যে তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন আসামীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।