শিরোনাম
প্রতিবেদন : মহসীন কবির।।
কুমিল্লা, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : ইমাম হাসান তায়িম পড়াশুনা করতেন নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজীনগর এমডব্লিউ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে। পৈত্রিক বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনার এতবাপুর গ্রামে। তবে বাবার চাকরির সুবাদে পরিবারের সাথে থাকতেন ঢাকার যাত্রাবাড়ির কাজলার পূর্ব রসুলপুর এলাকায়। তার বড় ভাই রবিউল আউয়াল সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে পড়ছেন। মেজো ভাই জাহিদ হাসান দেশের বাইরে মস্কোর একটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন।পুলিশ অফিসার বাবা ময়নাল হোসেন ও মা পারভীন বেগমের সাথে থাকতে থাকতেন একমাত্র সন্তান তায়িম (১৯)।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকে অন্যান্য সহপাঠীর সাথে সক্রিয় ছিলেন ইমাম হাসান তায়িম। নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হলেও চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিষয়টি তার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ মনে হতো।
তাই প্রায় প্রতিদিনই যাত্রাবাড়িতে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন। প্রথমে পরিবারের পক্ষ থেকে বাধা পেয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রতি নির্যাতন দেখে ক্ষোভে তার মা পারভীন বেগম তাকে আরও উৎসাহিত করতেন। শুধু তাই নয়, ছেলের সাথে পারভীন বেগম নিজেও বের হতেন। মূলত ছেলেকে চোখে চোখে রাখতেই আন্দোলনের পাশে অবস্থান নিতেন তিনি। তবে ২০ জুলাই কোনো একটি কাজে আটকে যাওয়ায় বের হতে পারেননি। আর সেদিনই তায়িমের পরিবারে নেমে এলো ঘোর অমানিশা। চিরজীবনের জন্য ছেলেকে হারাতে হবে তা ভাবতেও পারেননি মা পারভীনসহ স্বজনরা।
তায়িমের বাবা ময়নাল হোসেন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত। চাকরির কারণে সেই দিনগুলোতে তিনি পরিবারে তেমন সময় দিতে পারেননি। তবে কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছেলের সম্পৃক্ততা জানতেন। ন্যায্য দাবি হওয়ায় এক্ষেত্রে বাধা দেননি। অবশ্য সাবধানে থাকার পরামর্শ দিতেন।
তায়িমের বন্ধু রাহাতের বরাত দিয়ে বড় ভাই সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রবিউল আউয়াল জানান,২০ জুলাই দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিলো। দুপুর সাড়ে ১২টায় তার ছোট ভাই তায়িম ও বন্ধু রাহাত যাত্রাবাড়ির কাজলা ফুটওভার ব্রিজের কাছে একটি দোকানে চা খেতে গিয়েছিলো। এ সময় তাদেরকে দেখে কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই ৪০-৪৫ জনের পুলিশ দল এপিসি গাড়ি নিয়ে গুলি করতে করতে সামনে এগিয়ে আসে। প্রথমে তায়িমের পায়ে ও পরবর্তীতে কোমরে পরপর দু’টি গুলি ছোঁড়ে পুলিশ। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তায়িম। তখন তার বন্ধু রাহাত তাকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন। রাহাতকেও বেধড়ক মারধর করতে থাকে পুলিশ। সে মুহূর্তে তায়িম যে পুলিশের ছেলে সে কথা বলার সুযোগ ছিলো না। এ সময় বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে বন্ধুকে রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা করেন রাহাত। শেষ পর্যন্ত নিজেও পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাল ছেড়ে দেন। এক পর্যায়ে তায়িমকে রেখে দৌড় দেন তিনি।
রাহাত জানায়, পুলিশ যখন তায়িমকে ভ্যানে তুলছিলো, তখনও সে জীবিত ছিলো। এ সময় পুলিশের কতিপয় সদস্য জুতা দিয়ে আঘাত করে তার নাকের হাড় ভেঙ্গে ফেলেছিলো। পুলিশের মারমুখী আচরণে তখন তাকে উদ্ধারের কারও কোনো সুযোগ ছিলো না। তাই তার আশা ছেড়ে স্থানীয় কয়েকজন রাহাতকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। এর কিছুক্ষণ পর একজন এসে তায়িমদের বাড়িওয়ালাকে জানায় যে সে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তখন স্বজনরা ঘটনাস্থলে এসে জানতে পারে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়েছে। সেখানেও তাকে খুঁজে পাননি তার বড় ভাই রবিউল ও খালা সাহিদা আক্তার। শেষ পর্যন্ত বিকাল সাড়ে ৪টায় মর্গে তার লাশের সন্ধান পান তারা। বড় ভাই রবিউল বলেন, আমার ভাইয়ের ওপর নির্মম বর্বরতা চালিয়েছে পুলিশ। সুরতহাল রিপোর্টে দেখা গেছে তার শরীরে শতাধিক ছিদ্র। পুরো শরীর জুড়েই জখম ও গুলির দাগ।
তিনি জানান, তার ভাইয়ের মৃত্যুর পরপরই টানা কয়েকদিন গণমাধ্যম কর্মীদের চাপ ছিলো বাসায়। তখন তার মা কয়েকটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে খুনিদের বিচার চেয়েছেন। গত ২০ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতে ছেলে তায়িমের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন তিনি। পরদিন ২১ আগস্ট যাত্রাবাড়ি থানায় মামলাটি এজাহারভুক্ত হয়। এতে প্রধান আসামি করা হয় যাত্রাবাড়ি থানার তৎকালীন ওসি (তদন্ত) জাকির হোসেনকে। আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে। জাকির বর্তমানে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয়ে দায়িত্বরত।
গত ২২ নভেম্বর বাসস-এর এ প্রতিবেদক শহিদ তায়িমের পরিবারের সাথে সাক্ষাৎকারের জন্য গেলে বড় ভাই রবিউল জানান, তার মা এ মুহূর্তে গণমাধ্যমের সাথে আর কথা বলতে চান না। এর দু’টি কারণের একটি, নিজেদের নিরাপত্তা ও আরেকটি হলো বিচার ব্যবস্থার প্রতি অসন্তোষ।
তিনি আরো জানান, নিরাপত্তার কারণেই সম্প্রতি কাজলা থেকে বাসা বাসাবোর মাদারটেকে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাই এ প্রতিবেদকের সাথে সাক্ষাৎকার দেন বড় ভাই রবিউল ও খালা সাহিদা আক্তার।
এ সময় খালা সাহিদা আক্তার বলেন,তায়িমকে ছোটবেলায় কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। সে তার মায়ের চেয়ে বেশিরভাগ আমার কাছেই থেকেছে। ছোট বেলা থেকেই সে ছিলো প্রতিবাদী। তাই এবারের আন্দোলনেও সে ঘরে বসে থাকতে পারেনি।
তিনি জানান, একই স্থানে কয়েক দিন আন্দোলনে থাকায় পুলিশের টার্গেটে ছিলো তায়িম। তাই সুযোগ বুঝে সেদিন তাকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
তিনি আরও জানান, ঢাকা মেডিকেল থেকে তায়িমের লাশ গুম করার চেষ্টা করেছিলো পুলিশ। এমনকি পুলিশের সন্তান পরিচয় দেয়ার পরও লাশ নিয়ে লুকোচুরি করা হয়। শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করে মর্গে লাশ পাওয়া গেছে।
তিনি জানান, পরদিন ২১ জুলাই তার লাশ গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনায় নেয়া হলে জানাজা ও দাফনের জন্য পুলিশ আধা ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়।
আর স্থানীয় এতবারপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ জানাজার বিষয়টি মসজিদের মাইকে প্রচারে বাধা দেন। তিনি জানাজাও দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেন। তখন তিনি স্থানীয়দের বলতে থাকেন তায়িম শহিদ নয়। সে শিবিরের কর্মী। সন্ত্রাসী আন্দোলন করতে গিয়ে মারা গেছে।
সাহিদা অভিযোগ করেন, তায়িমের জানাজায় চান্দিনা থানার দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেননি। এমনকি এখন পর্যন্ত কেউ কোনো ধরনের খোঁজ-খবরও নেননি। অবশ্য জানাজায় বিএনপি নেতা শাওনসহ বিএনপি-জামায়াতের কিছু নেতাকর্মী অংশগ্রহণ করেছেন। তারা কারও কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো আর্থিক সহায়তাও পাননি বলে জানান। তিনি তায়িম হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের দাবি করেন। তায়িমের বড় ভাই রবিউল বলেন, তার ভাইয়ের হত্যাকারী পুলিশ কর্মকর্তা জাকির রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয়ে কর্মরত থাকলেও তাকে এখনও ধরা হয়নি।
তিনি অভিযোগ করেন, তায়িমের হত্যাকারীদের বিচারে গড়িমসি করা হচ্ছে। তিনি তার ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
চান্দিনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিয়া হোসেন জানান, তায়িমসহ শহিদ পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে। তাদের সবধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে বলে তিনি জানান।
বাসস/বিপ্র/সংবাদদাতা/১৫৩০/এপি