শিরোনাম
চট্টগ্রাম, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ (বাসস) : স্বপ্ন ছিল মালয়েশিয়া গিয়ে পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবেন। সে কারণে কাজের জন্য নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণও নেন।
যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পরিবারের ব্যয় বহনের একমাত্র সম্বল মুদি দোকানটি বিক্রি করে দেন। শারীরিক ফিটনেস পরীক্ষা দিয়ে কিছুটা পথ এগিয়েও রাখেন। কিন্তু তাঁর সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আর কখনো পূরণ হবেও না। ঘাতকের একটি বুলেটে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে রুবেল ও পরিবারের সোনালী স্বপ্ন। প্রাণে বেঁচে থাকলেও আর কোনধরনের ভারি কাজ করতে পারবেন না তিনি। দোকান, পুঁজি এবং কাজ করার শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে এখন তিনি অজানা ভবিষ্যত নিয়ে শংকিত দিন পার করছেন।
পাবনা জেলার চাটমোহর থানার বর্দানগর গ্রামের পিতৃহীন সোলায়মান মোল্লা এবং সাফিয়া বেগমের বড় ছেলে ২৬ বছরের টগবগে তরুণ মো. রুবেল হোসেন। পরিবারের হাল ধরার জন্য নগরীর শ্যামলী পলিটেকনিকে ভর্তি হয়েও আর্থিক অনটনে আর পড়ালেখা শেষ করা হয়নি। চট্টগ্রামের কালুরঘাট দিঘির পাড়ে মুদি দোকান দিয়েছিলেন। দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের মাধ্যমে মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর রুবেল মুদি দোকানটি বিক্রি করে দেন।
রুবেলের এক প্রতিবন্ধী ছোট ভাই রয়েছে। তার মা প্রতিবন্ধী ভাইটিকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তিনি স্ত্রী তিশা আকতার (২২)-কে নিয়ে নগরীর কালুরঘাট দিঘির পাড় এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। বাড়ি পাবনা হলেও জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম নগরীর কালুরঘাটের দিঘিরপাড়ে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিজের সম্পৃক্ততা এবং গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা বর্ণনায় রুবেল জানান, গত জুলাই মাসে কোটাবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে ২০ জুলাই থেকে নিয়মিত স্ত্রীসহ আন্দোলনে অংশ নিতেন। কখনো বহদ্দারহাট, কখনো নিউমার্কেট এলাকায় ছাত্র-জনতার সাথে আন্দোলনে যোগ দিতেন। সর্বশেষ গত ৪ আগস্ট নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় সকাল ১১টা থেকে স্ত্রী এবং শ্যালক জিসানসহ আন্দোলনে যোগ দেন। ওইদিন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগও ওই এলাকায় কর্মসূচি দেয়। একপর্যায়ে দু’পক্ষে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের মিছিলের সামনেই ছিলেন রুবেল। হঠাৎ করে তাঁদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে চারদিক থেকে যুবলীগ-ছাত্রলীগ-পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। বিকাল সাড়ে ৩ টার দিকে প্রতিপক্ষের একটি গুলি তাঁর পেটে লেগে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। তাঁর শ্যালক জিসান এ সময় পাশেই ছিলেন। ভগ্নিপতিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যেতে দেখে জিসান দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করে চান্দগাঁও শমশেরপাড়া ইন্ট্যারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে পেটে-পিঠে ব্যান্ডেজ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেন এবং তিনদিন পর দেখা করতে বলেন। স্বজনরা তাঁকে কালুরঘাট বাসায় নিয়ে যান। বাসায় যাওয়ার পর প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। পেট ফুলে যায় এবং প্রস্রাবের সাথে রক্ত বের হয়। ওই রাতে তিনি কিছুই খেতে পারছিলেন না। এমনকি পানি খেলেও বমি হচ্ছিল। শরীরে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়।
পরদিন সকালে আবার ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে নেয়া হলে ডাক্তাররা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাদের এ্যাম্বুলেন্সে করে মেহেদীবাগ ন্যাশনাল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন।
সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেও চারিদিকে পরিস্থিতি খারাপ থাকায় কোনো ডাক্তার আসতে পারছিলেন না। পরে তাঁকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু তাঁর অবস্থার ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকলে আইসিইউ’তে নিয়ে যাওয়া হয়। গত ৬ আগস্ট সকালে তাঁর পেটে অপারেশন করা হবে বললেও ব্লাডপ্রেশার অনেক কম থাকায় চিকিৎসকরা ঝুঁকি নেননি।
রুবেল বলেন, ‘বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষাশেষে ডাক্তাররা আমার স্বজনদের জানিয়েছিলেন, গুলিটি পেটে ঢুকে খাদ্যনালীর একাংশ ছিঁড়ে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। খাদ্যনালী ছিঁড়ে যাওয়ায় সেখানে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং বেশ কিছু অংশজুড়ে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। এ অবস্থায় রোগীকে বাঁচানো কঠিন। খবর শুনে আমার মা গ্রামের বাড়ি থেকে চলে আসেন। ওইদিন ওষুধ দিয়ে প্রেসার বাড়িয়ে বিকাল ৩ টার দিকে আমার বড় ধরণের অপারেশন করা হয়। পেটের ভেতর থেকে জমাট বাঁধা রক্ত বের করা হয়। খাদ্যনালীসহ ভেতরে যেসব অর্গান ছিঁড়ে গিয়েছিল সেসব সেলাই করা হয়। কিন্তু অপারেশনের পরেও নির্দিষ্ট সময়ে জ্ঞান না ফেরায় সবাই আমার বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। স্বজনদের উৎকণ্ঠার অপেক্ষার একপর্যায়ে আমার জ্ঞান ফিরে আসে। কিন্তু আমার অবস্থা এতটাই জটিল ছিল, ডাক্তাররা আমাকে পোস্ট অপারেটিভ রুমের পরিবর্তে আইসিইউ’তে পাঠিয়ে দেন। এ সময় আমার নিউমোনিয়া হয়ে যায়। সেই থেকে ১৬-১৭ দিনের মতো আইসিইউ’তে ছিলাম। পরে অবস্থার একটু উন্নতি হলে আইইসিইউ থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
ন্যাশনাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা বাবদ কোনো টাকা নেয়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘পেট ও পিঠের সেলাই করা অংশে প্রতিদিন ড্রেসিং করা হতো। ২৮ আগস্ট ন্যাশনাল হাসপাতাল থেকে আমাকে রিলিজ করা হয়। বাসায় আসার পর আবার খারাপ লাগা শুরু হওয়ায় ৩১ আগস্ট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে আমাকে ভর্তি নেয়া হয়। কিন্তু যখন দেখতে পাই, স্বজনদের হাসপাতালে আসা-যাওয়া এবং কিছু ওষুধ-ইনজেকশন কিনতে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে তখন চিন্তায় পড়ি। ডাক্তাররা সুস্থ হতে সময় লাগবে এবং সপ্তাহে দু’বার ড্রেসিং করতে হবে জানালে তাঁদের পরামর্শে ৬ সেপ্টেম্বর বাসায় চলে আসি। কিন্তু অপারেশনে কাটা পেটের ঘা না শুকানোয় বাসা থেকে হাসপাতালে যেতে অনেক কষ্ট হতো। প্রাইভেট গাড়িতে করে শুয়ে হাসপাতালে যেতে হতো, যা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। ডাক্তাররা আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে কিছু ওষুধ লিখে দেন এবং বাসায় ড্রেসিং করতে বলেন। অপারেশনের ৪ মাস পার হলেও ক্ষত শুকায়নি। এখনো সপ্তাহে দু’বার করে ড্রেসিং করতে হয়।’
রুবেল বলেন, ‘ন্যাশনাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর একটা অপারেশন করা প্রয়োজন হতে পারে বলেছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তাররা আর অপারেশনের প্রয়োজন নেই বলে জানান।’
রুবেল হোসেনকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন ১ লক্ষ, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন ৫০ হাজার ও ন্যাশনাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৩০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। ন্যাশনাল হাসপাতালে অপারেশন, ওষুধসহ ৭ লক্ষ টাকা বিল হয়েছিল যা ন্যাশনাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নেয়নি।
আন্দোলনের সাহসী যোদ্ধা রুবেল জানান, বাড়িতে প্রতিবন্ধী ভাইসহ মা তাঁর ওপর নির্ভরশীল। এখানে স্ত্রীকে নিয়ে একটি সংসার। ৪ আগস্টের পর থেকে মায়ের কাছে আর খরচের টাকা পাঠাতে পারেননি। আস্তে আস্তে সেরে উঠলেও ভবিষ্যতে ভারি কাজ করতে পারবেন কি না জানেন না।দোকান বিক্রির টাকা খরচ হয়ে গেছে। উপরন্তু প্রচুর ধার-দেনা হয়েছে।
এখন কিভাবে ধার শোধ করবেন, পরিবারের ভরণ-পোষণ হবে - এ দুশ্চিন্তা সার্বক্ষণিক তাঁকে অস্থির করে তোলে।
রুবেলের স্ত্রী তিশা আকতার রাউজান নোয়াপাড়া কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। আন্দোলনে সার্বক্ষণিক স্বামীর সাথে ছিলেন। রুবেল গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময়েও দু’জন নিউমার্কেট এলাকায় আন্দোলনে ছিলেন।
হতাশার সুরে রুবেল বলেন, ভবিষ্যতে মালয়েশিয়া যাবো সে আশাও নেই আর। পাসপোর্টটি হারিয়ে গেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে তাঁর স্ত্রীর জন্য একটি চাকুরির প্রত্যাশা করেন। পাশাপাশি তাঁর পরিবারটি কোনোভাবে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে সে উদ্যোগও যেন সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়।
রুবেল আশা করে বলেন, আমি একটি বৈষম্যহীন ও হানাহানিমুক্ত দেশ চাই। দেশের জন্য আমাদের সম্মিলিত ত্যাগকে যেন সবাই মনে রাখে।
তবে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরা এ বীর সেনানি দেশের প্রয়োজনে আবারও আন্দোলন-সংগ্রামে নামতে প্রস্তুত বলে জানান।
দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘আমি তো ৪ আগস্টেই মৃত্যুবরণ করেছি। এখান যেটা কাটাচ্ছি সেটা অতিরিক্ত জীবন। দেশের জন্য কিছু না করতে পারলে এ জীবন তো বৃথা। আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া জানাই।’