শিরোনাম
প্রতিবেদন : ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন
নাটোর, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ মিঠু বুক আর মুখমণ্ডলে অসংখ্য স্পিলন্টারের ব্যথা বয়ে বেড়াচ্ছেন। তবে তার চোখের আলো নিভে যাওয়াটাই সবচে করুণ আর ব্যথাতুর।
বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে দিশেহারা টগবগে তরুণ মিঠু (৩০) তবুও অকুতোভয়। মিঠু’র আর্তি-‘আমার চেখের আলো নিভে গেলেও নতুন প্রাণে জেগে উঠুক বাংলাদেশ, আলোকিত দেশ গড়ে উঠুক’।
আগস্টের চার তারিখের মধ্যাহ্ন। পাবনা’র এনায়েতপুর থানা এলাকা ছিলো অনেক বেশী উত্তাল। হাজারো ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের সহায়তায় কাজ করছিলেন মিঠু। এ সময়ে পুলিশ গুলি চালায় নির্বিচারে। এক পর্যায়ে বুক আর মুখমণ্ডলে গুলিবিদ্ধ হয়ে অচেতন হয়ে পড়েন মিঠু। একটা স্পিলন্টার বাম চোখে বিদ্ধ হয়। এখনও এটি চোখের পেছনে রয়ে গেছে।
আহত-নিহত অনেকের সাথে মিঠুরও ঠাঁই হয় খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। জ্ঞান ফিরলেও ফিরে আসেনি বাম চোখের দৃষ্টি শক্তি। গুলির স্পিলন্টার ছড়িয়ে আছে চোখের মধ্যে। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর মিঠুকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়ে বেড়িয়েছেন তার স্ত্রী নূপুর আর ছোট বোন শাপলা।
শেষে ২ অক্টোবর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে হয় চোখের রেটিনা অপারেশন। এই হাসপাতালে আগত নেপালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ টিম মিঠুর চোখ পরীক্ষা করে বলেছে, দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া রেটিনার রক্তনালীগুলো যদি অলৌকিক জোড়া লেগে যায় আর অপারেশনে ব্যবহার করা সিলিকন ওয়েল সংশ্লেষণ হয়ে একটুখানি যদি অবস্থার উত্তরণ হয়। তবে ফলোআপে থাকতে হবে নিয়মিত।
এখনো শরীরে থেকে যাওয়া ১৪টা স্পিলন্টার মিঠুর স্বস্তি পাওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে আছে। এগুলোর একটা বাম চোখের পেছনে, একটা ডান চোখের পাতায়। অন্য ছয়টা কপাল আর মুখোমণ্ডলে। এছাড়া বুকের পাঁজরে আরো ছয়টা রয়েছে। শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রনায় কাতর মিঠু কর্মহীন অবস্থায় দৌড়াদৌড়ি করছেন এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে।
প্রান্তিক কৃষক বাবা আব্দুল খালেক নিজেই হৃদরোগী। তার প্রয়োজন হৃদরোগের অপারেশন। কিন্তু একমাত্র ছেলের এই দুঃসময়ে জমি বিক্রি করে সন্তানের পাশে অবিচল দাঁড়িয়ে আছেন। বাগাতিপাড়া উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় মিঠুর চিকিৎসায় পাঁচ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে চিকিৎসা সহায়তার আবেদন করেছেন মিঠু।
মাধববাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় আর নাটোরের সিটি কলেজে পড়াশুনার পর্ব শেষ করে মিঠু হেলথ টেকনোলজি অব বরিশাল থেকে রেডিওলজিতে ডিপ্লোমা করেন। এরপর সংসারের হাল ধরতে শুরু হয় কর্মজীবন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে যোগ্যতা, দক্ষতার সাথে কাজ করেছেন। সর্বশেষ সিরাজগঞ্জের ড্যাফোডিল ইন স্পেশালিস্ট হাসপাতালে সিটিস্কান অপারেটর পদে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু চোখের দৃষ্টি হারিয়ে এখন তিনি কর্মহীন।
মাধববাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আসকান আলী জানান, মিঠু ছিলো মেধাবী শিক্ষার্থী। আচার-আচরণেও অনেক উন্নত।
‘মিঠু অনেক স্মার্ট শিক্ষার্থী ছিলো’-বললেন নাটোর সিটি কলেজের প্রভাষক (আইসিটি) মোঃ শহীদুল হক সরকার।
কৃষক আব্দুল খালেক (৬২) ও গৃহিণী মা জুলেখা খাতুনের (৫০) তিন মেয়ের পরে ঘর আলো করে আসে একমাত্র ছেলে মিঠু। অভাবের সংসারে উচ্চ শিক্ষার হাতছানিকে পাশ কাটিয়ে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে কর্মে প্রবেশ করেছিলেন মিঠু।
বাবা আব্দুল খালেক বলেন, ‘আমি নিজেই হার্টের রোগী। প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকার ওষুধ খেতে হয়। ওষুধের টাকা ছাড়াও প্রতিমাসে সংসারের ব্যয় নির্বাহে টাকা দিতো মিঠু।
আমার হার্টে রিং পরানো প্রয়োজন। কিন্তু আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। নিজের চিকিৎসা বাদ রেখে এখন জমি বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করছি। কারণ মিঠুই ছিলো আমাদের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম। ও যদি কর্মে না ফিরতে পারে, তবে আমাদের কি হবে?’
মা জুলেখা খাতুন বলেন, ‘মিঠু আমাদের সোনার ছেলে। এমন করে কেউ বাবা-মায়ের সংসারের বোঝা টানে না।’
শুধু বাবা-মায়ের সংসার চালানো নয় কর্মহীন হওয়াতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে নাটোর রাণীভবানী সরকারি মহিলা কলেজে সমাজকর্মে অধ্যয়নরত স্ত্রী’র পড়াশুনাও। সুদর্শন বাবার দিকে এক নয়নে তাকিয়ে থাকে ছোট্ট ফুটফুটে সন্তান মুগ্ধ। কিন্তু ও বোঝেনা তাঁর বাবা এক চোখে দেখতে পায় না।
মিঠু বলেন, আগামী সপ্তাহে চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে অপারেশনের তারিখ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। আমার বাম চোখে ছানি পড়েছে। ঐ ছানি অপারেশন করে লেন্স বসানো হবে।
আর রেটিনাতে সিলিকন ওয়েল দেওয়া হবে।
যথাযথ চিকিৎসায় দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়ার আর্তি মিঠুর। তারপরও ওর প্রত্যাশা, ‘আমার চোখের আলো নিভে গেলেও দেশটা যেন আর অন্ধকারে না ফেরে, আলোর পথে যেন চলে।’