বাসস
  ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫২

ছেলে যে আর ফিরবে না, তবু ভাত নিয়ে এখনও অপেক্ষায় মা

প্রতিবেদন : মোঃ মঞ্জুর মোর্শেদ 

মুন্সীগঞ্জ, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪ ( বাসস) : আদরের সন্তান  দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। ছেলেকে আর ফিরে পাবো না। কিন্তু  ছেলের আত্নত্যাগের স্বীকৃতি যেন দেওয়া হয়। সরকার যেন সকল শহিদকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়। 

এ দাবি  সন্তান হারা পিতা মোঃ মনিরুজ্জামান তাজুলের। 

তার ছেলে মোঃ মোস্তফা জামান সমুদ্র বৈষম্য বিরোধী ছাত্র- জনতার আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন। সমুদ্র দেশের জন্যে জীবন দিয়ে শহিদ হয়েছেন। 

মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার মধ্যপাড়া গ্রামের নিবাসী মোঃ মনিরুজ্জামান তাজুল ঢাকার রামপুরায় মহানগর প্রজেক্টে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। তার ছেলে শহিদ মোঃ মোস্তফা জামান সমুদ্র (১৭) ঢাকার আল-ফোরকান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেছেন। সিদ্বেশ্বরী কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। 

শহিদ মোঃ মোস্তফা জামান সমুদ্রের পিতা মোঃ মনিরুজ্জামান তাজুল(৬৮)বাসসকে বলেন, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই  মোস্তফা জামান সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। গত ১৯ জুলাই অন্যান্য দিনের মতো সমুদ্র  সকালে বাসা থেকে সহপাঠীদের সাথে রামপুরায় ডিআইটি রোডে নেমে আসে। বেলা ৩ টায় আমি  জুমার নামাজ শেষে বাসায় এসে ভাত খেতে বসি। আর সমুদ্রের মা নামাজে দাঁড়ায়। এমন সময় ওর এক বন্ধু ফোন করে বলে,  সমুদ্র গুলিবিদ্ধ হয়ে ডেলটা হাসপাতাল আছে। 

কাঁদতে কাঁদতে সমুদ্রের পিতা আরো  বলেন , খাবার ফেলে দৌড়ে ডেলটা হাসপাতাল গিয়ে দেখি পাঁজরে গুলিবিদ্ধ আমার ছেলে খালি গায়ে মেঝেতে পড়ে আছে। শরীরে হাত দিয়ে দেখি শরীর গরম। সাথে সাথে কোন রকমে সেখান থেকে পাশের বেটার লাইফ হাসপাতাল নিয়ে যাই। সেখানকার ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। সেদিন রাতেই নিজ গ্রামে এনে জানাজা শেষে দাফন করি তাকে। 

তিনি বলেন, সমুদ্র এর আগের দিন আন্দোলনে গিয়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাসায় আসে। ঘটনার দিন নিষেধ করেছিলাম  বাইরে যেতে। তারপরও সকালে বন্ধুদের সাথে রাজপথে নেমে আসে। সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তির জন্য ফরম এনেছিল।পরের রোববার ভর্তি হবার  কথা ছিল।সমুদ্রের ইচ্ছা ছিল পড়াশুনা শেষ করে দেশেই ব্যবসা করবে। 

মনিরুজ্জামান  বলেন, দুই পুত্র আর এক কন্যার মধ্যে সমুদ্র ছিল সবার ছোট। বড় ছেলে মোর্শেদুজ্জামান  পিএইচডি করে  জাপানে আছে। আর মেয়ে  মিরানা জামান  স্বামীর সাথে ফিনল্যান্ডে বসবাস করে। ইচ্ছা ছিল ছোট ছেলেকে নিয়ে দেশেই থাকবো। ব্যবসা বাণিজ্য করবো। সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। তাই ঢাকায় সব ফেলে স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি। 

শহিদ সমুদ্রের মা মাসুদা জামান(৫৯) বাসসকে বলেন, সমুদ্র  সকালে বলে যায় জুম্মার নামাজ পরে বাসায় এসে দুপুরের ভাত খাবে। আমি ভাত বেড়ে সন্তানের অপেক্ষায় থাকি । দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে  ফোন করে  সমুদ্রকে বাসায় খেতে আসতে  বলি। সে দুই মিনিট পরে আসার কথা বলে। দুপুর গড়িয়ে যায়। সমুদ্র বাসায় আসে না। টেবিলে ভাত বেড়ে আমি নামাজ পড়তে যাই। নামাজ পড়া অবস্থায় ফোন আসে সমুদ্র গুলি খেয়েছে। 

সমুদ্রের মা এখনো চোখের পানি ফেলে আর বলে,   আমার বাবা আর ভাত খেতে আসে না। আমি অপেক্ষায় থাকি। আমার অপেক্ষা শেষ হয় না।

দুঃখের সাথে তিনি বলেন, আমার ছেলে দেশের জন্যে রক্ত দিলো। অথচ কেউ খোঁজ নেয় না।

সমুদ্রের পিতা মনিরুজ্জামান তাজুল বাসসকে বলেন, মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন  নগদ ১০ হাজার টাকা দিয়েছে। আর কেউ খোঁজ নেয়নি। কোন আর্থিক সাহায্য চাই না।

আদরের সন্তান অবিচার অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে। তাই সরকারের নিকট দাবি  আমার ছেলেসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছে তাদের যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়।