শিরোনাম
প্রতিবেদন: মামুন ইসলাম ও রেজাউল করিম মানিক
রংপুর, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ (বাসস) : বাবু মিয়া, পেশায় সবজি ব্যবসায়ী। প্রতিদিন সকাল হলেই ছুটে যেতেন সিটি বাজারে, সবজির দোকানে। যা আয় হতো তাই দিয়ে টেনেটুনে চলতো অভাবের সংসার।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। এখন পায়ে গুলি নিয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছেন। অর্থাভাবে তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা না হওয়াতে পঙ্গুত্বের আশঙ্কায় দিন কাটছে পরিবারের সদস্যদের। এখন নিজের অজানা ভবিষ্যৎ ভেবে ভেবে আশংকায় দিন কাটাচ্ছেন অসহায় বাবু মিয়া(৬৫)।
রংপুর মহানগরীর জুম্মাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবুল হোসেন ও করিমুনেচ্ছার পাঁচ ছেলে মেয়ের মধ্যে তৃতীয় বাবু মিয়া। সবাই কৃষি কাজ করলেও একমাত্র বাবু মিয়াই সবজি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
স্ত্রী মেহেরবানু (৬০) ও তিন সন্তান নিয়ে ভালোই চলছিল সংসার। কিন্তু বাবু মিয়া এখন ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এখনো তার পায়ের ভেতরে অন্তত ১১ থেকে ১২ টি বুলেট রয়েছে। থেমে থেমে পা থেকে রক্ত, পুঁজ ঝরছে। ব্যথা আর তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। চোখের দুই কোণ দিয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রু। দিনভর স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউয়েরা সেবা দিয়ে আসছেন আহত বাবু মিয়াকে।
বর্তমানে হাঁটা-চলা করতে পারছেন না তিনি। অন্যের কাঁধে ভর করে হাঁটাহাঁটির চেষ্টা করেন। সবজি বিক্রি করে যে বাবুর সংসার চলতো, এখন তিনিই অন্যের সহায়তার জন্য তাকিয়ে আছেন। অর্থের অভাবে ঔষধ কিনে খেতে এবং চিকিৎসা করতে না পারায় দিন দিন তার অবস্থার অবনতি হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের শঙ্কা- যে কোনো সময় পচে যেতে পারে বাবু মিয়ার পা। এতে করে তিনি পঙ্গুত্ববরণ করতে পারেন।
জানা যায়, গত ১৯ জুলাই বিকেলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রংপুর সিটি বাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ ঘটে। পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ চলে। ছাত্র-জনতাকে দমাতে পুলিশ এপিসি গাড়ি থেকে গুলি ছোঁড়ে এবং ছররা গুলি, রাবার বুলেটসহ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে।
উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে তড়িঘড়ি করে দোকান বন্ধ করেন সিটি বাজারের সবজি বিক্রেতা বাবু মিয়া। এ সময় তিনি হঠাৎ পায়ে আঘাত অনুভব করেন এবং দেখেন পা থেকে রক্ত ঝরছে। তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসক তার পা থেকে দুটি গুলি বের করে দিয়ে ঔষধ লিখে দেন। কিন্তু বাবু মিয়ার পায়ের গভীরে আরও কয়েকটি গুলি রয়েছে, যা বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা সম্ভব বলে চিকিৎসক জানান।
গুলিবিদ্ধ বাবু মিয়া বলেন, ‘বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিটের দিকে, আমি দোকান বন্ধ করি। এ সময়ে আমার সবজির দোকানের সামনে এসে পুলিশ আমাকে বাম পায়ে গুলি করে। যে পুলিশ আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করছিল তার মুখ আমি দেখতে পাই।’
তিনি হঠাৎ পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন এবং পা থেকে রক্ত ঝরতে দেখেন। এসময় বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রক্তপাত ও প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে উল্টো দিকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন।
বাবু মিয়া বলেন, ‘সে সময় স্থানীয়রা আমাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (আরপিএমসিএইচ) পাঠানোর চেষ্টা করেন। পুলিশ এলাকাটি ঘেরাও করে রাখায় তারা আমাকে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেননি।’
আনুমানিক সন্ধ্যা ৬টায় তারা প্রত্যন্ত এলাকার রাস্তা দিয়ে রিকশায় করে জুম্মাপাড়া, নিউ জুম্মাপাড়া পাকারমাথা, জলকর, সোডাপীর মাজার ও মেডিকেল পূর্ব গেট এলাকা দিয়ে বাবু মিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যান ।
বাবু মিয়া বলেন, ‘এসময় হাসপাতালে অসংখ্য গুলিবিদ্ধ রোগীর ভিড় থাকলেও দায়িত্বরত ডাক্তার, নার্স, ইন্টারনি ডাক্তার এবং স্টাফরা খুব সহযোগিতামূলক ছিলেন। তারা সেখানে আমার চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করেছিলেন। ডাক্তার আমার বাম পা থেকে দুটি গুলি বের করে ঔষধ লিখে দেন।’
এসময় চিকিৎসক বাবুকে জানান, তার পায়ের গভীরে আরও কয়েকটি গুলি রয়েছে, যা বড় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করা সম্ভব হতে পারে।
বাবু বলেন, ‘যেহেতু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া গুলিবিদ্ধ সকল রোগীকে সন্ত্রাসী হিসাবে গ্রেপ্তার করতে সন্ধান করা হচ্ছিল, সেজন্য গ্রেফতার এড়াতে আমাকে সেই রাতেই রিলিজ পেপারের মতো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না নিয়েই হাসপাতাল ছাড়তে হয়েছিল।’
হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরার পর দীর্ঘ প্রায় তিন মাস ধরে বিছানায় শুয়ে দিন কাটছে বাবু মিয়ার। তার পরিবারে স্ত্রী, তিন ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি-নাতনি রয়েছে। ছেলেরা দিনমজুর হওয়ায় বাবার পায়ের অস্ত্রোপচার ও ঔষধ কিনে খাওয়ানোর অর্থ জোগাড় করতে পারছেন না। তাই ধীরে ধীরে বাবু মিয়ার পায়ের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। পরিবারের সদস্যরা এলাকার কিছু বিত্তবানদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে বাবু মিয়াকে ঔষধ কিনে খাওয়াচ্ছেন।
বাবু বলেন, এখনও কিছু গুলি পায়ের ভেতরে রয়েছে। দিনভর পা ব্যাথা করে, হাঁটতে পারি না। কবে আবার সুস্থ হয়ে বাজারে যেতে পারবো এই চিন্তা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
বাবু মিয়ার ছেলে হামিদুল বলেন, বাবার পা থেকে দুইটা গুলি বের করা হয়েছে। বাকিগুলো পায়ের বেশি ভেতরে থাকায় চিকিৎসকরা বের করেননি। মেডিকেল থেকে বলছিল যেসব ঔষধ লেখা হয়েছে সেগুলো খেলে গুলিগুলো পা থেকে বের হয়ে যাবে। কিন্তু গুলি তো বের হয়নি বরং এখন পায়ের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বাবার চিকিৎসার জন্য সরকারি কিংবা বেসরকারি কোন সাহায্য সহযোগিতা আমরা পাইনি। বাবার চিকিৎসা করাবো সেই টাকাও আমাদের নেই। আমাদের নিজেদের সংসারই চালাতে পারি না, বাবার চিকিৎসা কি দিয়ে করাবো।
পুত্রবধূ আছিয়া বেগম বলেন , আমার শ্বশুরের পা থেকে রক্ত, পুঁজ বের হচ্ছে। সারাদিন সেই পা মুছতে মুছতে আমাদের দিন কাটে। উনার আয় সংসারের কাজে লাগত।
কিন্তু এখন তিনি কাজ করতে না পারায় টাকা-পয়সার অনেক সমস্যা হচ্ছে। তার ওপর দামি দামি ঔষধ খাওয়াতে হচ্ছে। আমি চাই সরকার যেন দ্রুত আমার শ্বশুরের চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
প্রতিবেশী আমিনুল ইসলাম বলেন, বাবু চাচা অসহায় মানুষ। তার পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হওয়ার পর তার উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা পাড়া-প্রতিবেশী সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করেছি। সরকারি কিছু অনুদান পেলে চাচার পা থেকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গুলিগুলো বের করা যেত। তাহলে তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতেন।
জানা গেছে, অতিসম্প্রতি স্থানীয় এক সাংবাদিকের উদ্যোগে বাবু মিয়াকে রংপুর মেডিকেলের সার্জারি বিভাগে নেয়া হলে তাকে ৬ নং ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়। তার সুচিকিৎসার যথাসাধ্য চেষ্টা চলছে।
তবে দরকার সরকারি, বেসরকারি আরো সাহায্য।