শিরোনাম
প্রতিবেদন: বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : দীপঙ্কর বালা। মাদারীপুর সরকারি কলেজের গণিত বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতক পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েছেন। গত ১৯ জুলাই সকালে আন্দোলনে যোগ দেন। দুপুর হতে না হতেই পুলিশের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয় তার পা। পরদিন ২০ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে।
তিনি বলেন, আন্দোলনের প্রথম দিকে কলেজের ভেতরে ছোট মিছিল করি। বড় আকারে শুরু হয় চীন থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ‘রাজাকার’ বলার পর।
দীপঙ্কর জানান, গত ১৯ জুলাই মাদারীপুর সদর উপজেলার ডিসি ব্রিজ এলাকায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের মিছিল হচ্ছিলো। বিকেলে ৫ টার দিকে টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। কিন্তু বাসায় না গিয়ে অংশ নেন মিছিলে। সন্ধ্যা সাতটার দিকে পুলিশ মিছিলে গুলি চালানো শুরু করে।
তিনি বলেন, ‘ওই দিন আমিসহ মাদারীপুরে অন্তত ৪০ জনের মতো গুলিবিদ্ধ হয়। সব মিলিলে ৭০ জনের বেশি আহত হয়।’
সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের শয্যায় বসে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আহত দীপঙ্কর বালার(২৪)।
তিনি বলেন, ছয়দিন আইসিইউতে অজ্ঞান ছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর জানতে পারি ছয়টা দিন কেটে গেছে! কিভাবে জীবন থেকে ছয়টা দিন কেটে গেলো টেরই পেলাম না। টানা পাঁচমাস হাসপাতালে। চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টায় এখনও পা কেটে ফেলতে হয়নি। হয়তো অল্পদিনে বিদেশে পাঠানো হবে। কিন্তু দুশ্চিন্তা কাটছে না। আমি কি পারবো, আগের মত স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে?’
দীপঙ্কর বালা বলেন, জ্ঞান ফিরলে জানতে পারি, গুলি লাগার পর মাদারীপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমাকে। সেখানে ভর্তি করেনি। তাই নিয়ে আসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক)। সেই ২০ জুলাই থেকে এখানে ভর্তি।
দীপঙ্কর বালার মা বিনা রাণী বালা (৫০) বলেন, ‘আমার ছেলে আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচ মাস আগে মেডিকেলে এসেছে। তার বাপ হার্টের রোগী। কোনো ইনকাম নাই। পোলা টিউশন কইরা ঘর চালাইত। সেইটাও বন্ধ হয়ে গেছে। আমার পোলা কবে হাঁটতে পারবে, কবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে, কোনো নিশ্চয়তা নাই। সরকারি কোনো সহযোগিতা না পাইলে আমরা কেমনে চলব? চিকিৎসকরা বলছে ওরে বিদেশে পাঠানো হইবো। কিন্তু কবে পাঠানো হইবো, তা কইতে পারে না। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই পোলাডারে যেন তাড়াতাড়ি বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।’
দীপঙ্কর বালা মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার পাকুল্লা গ্রামের পরেস চন্দ্র বালার (৫৮) ছেলে। গত ১০ জুলাই থেকে মাদারীপুরে যুক্ত হন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে।
দীপঙ্কররা তিন ভাই। বড় ভাই বিবাহিত। তাদের এক সন্তান আছে। তারা মা-বাবা, তিন ভাই, বৌদি, ভাতিজা- সবাই এক সঙ্গে থাকেন। তিনি মেজো। ছোট ভাই অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
বিদেশ পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে জানিয়ে দীপঙ্কর বালা বলেন, পাসপোর্ট ছিলো না। দুইদিনের মধ্যে আমার পাসপোর্ট প্রস্তুত হয়। তারপর তা জমা নিয়েছে। আশা করছি আগামী সপ্তাহের শুরুতেই ভিসা হয়ে যাবে।
এই পাঁচমাসে পা নিয়ে তাকে সীমাহীন কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, পায়ের ক্ষত জায়গাটা ভরাট হতে দুই থেকে আড়াই মাস লেগেছে। মাংস ভরাট হতে হতে আরেক সমস্যা দেখা দেয়। হাড় বৃদ্ধি পেয়ে একটা আরেকটার মধ্যে ঢুকে যায়। ভেতরে পচন ধরে। অপারেশন করে সেই হাড় কেটে ফেলতে হয়। এ পর্যন্ত আমার পাঁচ দফায় অপারেশন হয়েছে।
আর্থিক সমস্যার বিষয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দাদা আর আমি টিউশনি করে সংসার চালাতাম। এখন সংসারে বিরাট প্রভাব পড়ছে। আমি টিউশনি করতে পারি না। উল্টো আমার পেছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে হয় পরিবারকে। আমার বাবাও অসুস্থ। সরকার এক লাখ টাকা দিয়েছে। তাতে কিছুই হয়নি। সরকার থেকে প্রথম পর্যায়ে ঔষধপত্র দেয়নি।
গত ২০ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত। এরকম একটা রোগী আমি। মাদারীপুর থেকে ঢাকায় আনতে ওই দিনই অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া লেগেছে ১৮ হাজার টাকা।’
পা দেখিয়ে দীপঙ্কর বলেন, পা তো ভাঙ্গা ছিলো। এখান থেকে এ পর্যন্ত ঝুলে পড়ছিলো। ওই দিনই পায়ে রড় লাগায়। তাতে খরচ হয়েছে ৮ হাজার টাকা। কেউ ভাবেনি যে পা থাকবে।
শুধু এখানকার ডাক্তারদের চেষ্টায় পা আছে। না হলে পা কেটেই ফেলতে হতো।
তিনি বলেন, ছয় দিন আইউসিইউতে অচেতন অবস্থায় ছিলাম। তখন অনেক দামি দামি ইনজেকশন কিনে দিতে হয়েছে। ২০ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত ১৭ দিনে না হলেও আমার চিকিৎসায় চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এই যে এখানে এতো দিন আছি, আমার সঙ্গে তিনজন লোক থাকে, আমাকে তো ভালো ভালো মাছ, মাংস, ফল খাওয়ানো লাগে। তিন বেলা খেতে কি পরিমাণ টাকা খরচ হয়, বলুন। আমারই দিনে প্রায় এক হাজার টাকা লাগে। ডাবের পানি আনে, তা দেড়শ টাকার নিচে হয় না। এ পর্যন্ত অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে।
ঢামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, দীপঙ্করের বাম পায়ে গুলি লাগে। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। সেখানে চামড়া মাংসও কিছু ছিলো না। অর্থোপেডিক্স সার্জনরা এক ধরনের এক্সটার্নাল ফিক্সেটল দিয়ে ফিক্সড করেন। পরে ওই জায়গা মাংস ভরাট করা হয়। তবে তার পা সম্পূর্ণ ঠিক হওয়া নিয়ে আমরা কিছুটা চিন্তিত। অনেক সময় লাগবে।
তিনি বলেন, ‘একটা ইয়াং ছেলে। তার পা সম্পূর্ণ ঠিক হওয়া নিয়ে আমরা চিন্তিত। লম্বা সময় লাগবে। বিদেশে আরও উন্নত চিকিৎসা দেওয়া যায় কি না, আমরা বিবেচনা করছি। আমাদের চেয়ে আরও অ্যাডভান্স কান্ট্রিতে নিয়ে চিকিৎসা দিতে পারলে তার ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’