বাসস
  ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:১০

দাফনে পুলিশের বেঁধে দেয়া সময়ের কারণে ছেলের মুখটাও ঠিকমতো দেখতে পারেননি মা

প্রতিবেদন : আজাদ রুহুল আমিন

বাগেরহাট, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪(বাসস) : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে বেগবান করতে একপর্যায়ে হাজারো ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে এসেছিল। বসে থাকেননি টগবগে তরুণ মোঃ ছাব্বির মল্লিকও।

আন্দোলনে যোগ দিতে ছাব্বির মল্লিক (২০) এইচএসসি’রদুটি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে ১৭ জুলাই ঢাকায় চলে যান। যাওয়ার আগে মাকে বলেন, বোনের বাচ্চাদের জন্যে তার খুব মন পুড়ছে। তাদের দেখতে ইচ্ছে করছে।

বড়ো বোন ফারহানা শারমিন গাজীপুরে বসবাস করেন। ছাব্বির এসে তার বাসায় ওঠেন। ভাগনা, ভাগনিদের জন্যে‘মজা’ কিনতে যাওয়ার কথা বলে ১৯ জুলাই বাসা থেকে বের হয়ে যান। কিন্তু আর ফিরে আসেননি।

ছাব্বির এমন এক  তরুণ ছিলেন যেখানেই আন্দোলন, প্রতিবাদ সেখানেই তার সরব উপস্থিতি ছিল। তিনি ছিলেন খুবই মানবিক। নিজে প্রাইভেট পড়িয়ে সেই টাকা দিয়ে গরিব অসহায়দের সাহায্য করতেন। তার দাদা,বাবা সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। তাই তারও স্বপ্ন ছিলো একদিন তিনি সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হবেন।কিন্তু তার সেই স্বপ- সাধ আর পূরণ হলোনা।

বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলার হিজলা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য মোঃ শহিদুল মল্লিক (৫৭) ও গৃহিণী কাকলি বেগমের (৫৩) চার সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র ছাব্বির মল্লিক ছিলেন স্থানীয় শেরে বাংলা ডিগ্রি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র।তিন বোনের এক ভাই ছিলেন ছাব্বির।

তিনি ১৯ জুলাই ঢাকার উত্তরায় বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন।সেদিন বিকেলে পুলিশের গুলিতে আহত হলে তাকে সহযোদ্ধারা উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করে।রাত ১০ টায় হাসপাতাল থেকে বড়ো বোনকে ফোন দেয়া হয়। তারা দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে দেখেন ভাইয়ের গুলিবিদ্ধ লাশ।

ছাব্বিরেরবাবা ঢাকায় একটি সিকিউরিটি কোম্পানিতে গার্ডের চাকরি করতেন। একমাত্র ছেলের মৃত্যু সংবাদ শুনে শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন তিনি। ওই রাতেই ঢাকা থেকে অ্যাম্বুলেন্সেকরে নিয়ে আসার পথে আওয়ামী গুণ্ডাবাহিনী‘ছাত্রলীগ’তাদের ওপর হামলা চালায়।অ্যাম্বুলেন্সভাঙচুর করে।  লাশের ওপর ককটেল নিক্ষেপ করে। সে এক ভয়াবহ ও নিষ্ঠুরতম ঘটনা যা ১৯৭১  সালের পাকবাহিনীর নির্মমতাকেও হার মানায়।

ছেলের লাশ বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসতে ছাব্বিরের পিতা ও বোনকে ব্যাপক বাধার মুখে পড়তে হয়। গোপালগঞ্জের মোল্লাহাট ব্রিজ পর্যন্ত এ বাধার মুখে পড়েন তারা।

এ প্রসঙ্গে বড়ো বোন ফারহানা শারমিন(৩১) বলেন, উত্তরা থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্তই আমরা ২০ থেকে ২৫ বারের মতো বাধার মুখে পড়ি। এরপরও কিছু সময় পর পরই  আমাদের গাড়ি আটকে দেয়া হচ্ছিল। আর বলছিল, আমরা যেন লাইট না জ্বালাই, হর্ন না বাজাই।

এদিকে হিজলা বাজার থেকে কানন চক বাজার পর্যন্ত সাদাপোশাকেপুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। পুলিশ নির্দেশ দেয়,  অল্প সময়ে মধ্যেই জানাজা ও দাফনের কাজ শেষ করতে হবে। এমনকি ছাব্বিরদের  গ্রামের বাড়িতে হামলারও প্রস্তুতি চলে।

গত ২০ জুলাই রাত ৩ টায় লাশ এসে বাড়ি পৌঁছায়। কোনরকম তড়িঘড়ি গোসল দেয়া হয়। জানাজা শেষে রাত ৪ টার দিকে পারিবারিক কবরস্থানে শহিদ ছাব্বিরকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।

এ প্রসঙ্গে ফারহানা বলেন, লাশ নিয়ে আসার পর পুলিশ মাত্র ৪০ মিনিটের মধ্যে দাফন, জানাজা সব শেষ করতে বলে। আমার দুঃখিনী মা  ছেলের মুখটাও ঠিক মতো দেখার সুযোগ পাননি।

শহিদ ছাব্বিরের মা এখনও শোকে বিহব্বল। ‘ছেলে আমরা লেখাপড়া শিখে সেনা কর্মকর্তা হবে, অথচ তাকে মেরা ফেলা হলো’ এই বলে বার বার আহাজারি করছিলেন।

ছাব্বিরের তিন বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা শহীদুল মল্লিক খুবই গরীব। একমাত্র ছেলের অকাল প্রয়াণে সিকিউরিটির চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে এসেছেন।পেনশনের টাকায় কোন রকম সংসার চলছে।

শহীদুল মল্লিক জানান, তারা ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে নগদ ২ লাখ টাকা, আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে ১ লাখ টাকার চেক, সমাজকল্যাণ চিতলমারী অফিস থেকে ৫ হাজার টাকার চেক,মোল্লাহাটের স্থানীয় বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার মাসুদের কাছ থেকে ২৫ হাজার ও এক আমেরিকান প্রবাসীর কাছ থেকে ৯ হাজার টাকার সাহায্য  পেয়েছেন।

এদিকে ছাব্বিরের বাবা গত ১৯ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন। এছাড়া নিহতের পরিবারকে সান্ত¦না দিতে বাগেরহাটের পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম আরিফ শহিদ ছাব্বিরের বাড়ি পরিদর্শন করেছেন। তবে প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কেউ পরিবারটির কোন খোঁজ নেয়নি।

ছাব্বিরের পিতা মাতা বর্তমানে ছেলের শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তারা এখনও সারাদিন কান্নাকাটি করেন। তাই ছাব্বিরের বড়ো বোন শারমিন কিছুদিনের জন্যে পিতা মাতাকে সঙ্গ দিতে  গাজীপুর থেকে বাড়ি গেছেন।

পরিবারের সকলেই ছাব্বির হত্যায় যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।