বাসস
  ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৬

‘কারো বাবা ডাক শুনলেই আমার সন্তানেরা ডুকরে কেঁদে ওঠে’ -শহিদ ফারুকের স্ত্রী

চট্টগ্রাম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ (বাসস) : দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ঘোর অমানিশার অন্ধকারে দিন কাটছিল শহিদ ফারুকের স্ত্রী সীমা আকতারের। এখন তাঁর বিশ্বাস, সরকারের সহযোগিতা এবং তাঁদের চেষ্টায় সেই আঁধার কাটিয়ে একদিন আলোর মুখ দেখবে তাঁর পরিবারটি।

কম বয়সে বিধবা হওয়া সীমা হয়তো আর কখনও পাবেন না স্বামীর যত্ন-ভালোবাসা। অবুঝ দুই সন্তান কোনোদিনও ফিরে পাবে না তাদের পরম আরাধ্য বাবাকে। বুকের ভেতরে গভীর কষ্ট চেপে রেখে তাদের জীবনের দিনগুলো কাটবে। দুই সন্তান লেখাপড়া করে স্বাবলম্বী হলে একদিন হয়তো এ ছোট্ট ঘরটি অনেক বড়ো হবে। 

কোটা আন্দোলনের শহিদ, ফার্নিচার মিস্ত্রি মো. ফারুকের পরিবারের জন্য স্ত্রী সীমা আকতারের মতো এমন প্রত্যাশা এদেশের লক্ষ-কোটি মানুষের। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশের অন্যতম নির্মাতা ফারুকের পরিবারের জন্য এ প্রার্থনা পুরো দেশবাসীর।

পেশায় ফার্নিচার মিস্ত্রি মো. ফারুকের বয়স ছিল ৩২ বছর। গত ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুর এলাকায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সাথে কোটা আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে শহিদ হন তিনি। 

পরিবার ও কর্মস্থল সূত্রে জানা যায়, ফারুক ওইদিন দুপুরে তাঁর কর্মস্থল মুরাদপুরস্থ শাহজালাল ফার্নিচারের দোকান হতে কাজ করে দুপুরের খাবার খেতে যান কাছের বিসমিল্লাহ হোটেলে। সেখান থেকে ফেরার পথে হঠাৎ করে দু’টি গুলি তাঁর বুকের বাম পাশে এবং পিঠে লাগে। গুলি লাগার পর ফারুক হেঁটে তাঁর কর্মস্থলে ফেরার চেষ্টা করেন। কিন্তু অল্প কিছ ুদূর যাওয়ার পর তিনি আইল্যাণ্ডের মাঝখানে পড়ে যান। এ সময় ওই পথে যাচ্ছিলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার দুই ছাত্র। তাঁরা ফারুককে রক্তাক্ত ও গুলিবিদ্ধ দেখে তাঁকে নিয়ে একটি রিক্শায় ওঠেন। কিন্তু চারিদিকে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের কারণে তাঁরা যেতে বাধা পাচ্ছিলেন। এপথ-ওপথে অনেক্ষণ ঘুরে ফারুককে নিয়ে তাঁরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে  পৌঁছান। 

এদিকে, কর্মস্থল শাহজালাল ফার্নিচারের মালিক ঘটনাটি শুনে দ্রুত লালখানবাজারে ফারুকের বাসায় গিয়ে তাঁর স্ত্রী সীমা আকতারকে খবর দেন। ফারুকের স্ত্রী ফোনে তাঁর বাবা ও ভাইকে ঘটনাটি জানান। সীমার ভাই দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে যান। রক্তে ভেজা শার্ট দেখে প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে চেহারা দেখে ফারুককে শনাক্ত করেন তিনি। এর অল্প কিছু সময়ের মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছান ফারুকের স্ত্রী সীমা আকতার। 

সীমা আকতার বাসস’কে বলেন, ‘মাদ্রাসার ওই দুই ছাত্র আহত ফারুককে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। আমার স্বামী একজন অপরিচিত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে এবং অনেক চেষ্টা করে মেডিকেল নিয়ে এসেছিলেন। আমি তাঁদের মুখে শুনেছি, হাসপাতালে নেয়ার পরও আমার স্বামীর জ্ঞান ছিল। কিন্তু ডাক্তাররা তাঁর চিকিৎসার চেষ্টা না করে তাঁকে ইমার্জেন্সির একটি বেডে রেখে দিয়েছিলেন। এর আরো ঘণ্টাখানেক পরে, বিকেল ৪ টার দিকে ফারুক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।’

বুকে কষ্ট চেপে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে নেয়ার সাথে সাথে একজন মানুষ হিসেবে যদি ডাক্তাররা ব্যবস্থা নিতেন হয়তো ফারুককে বাঁচানো যেতো।’ 

সীমা জানান, নিহত ফারুকের লাশ ময়নাদতন্তের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হলে পরদিন তাঁকে কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কুটুমপুরে শ্বশুর বাড়ির কবরস্থানে দাফন করা হয়। 

ফারুকের স্ত্রী জানান, প্রতিদিনের মতো ওইদিনও ফারুক সকাল সাড়ে ৮ টার দিকে কর্মস্থলের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। 

সীমা-ফারুক দম্পতির এক ছেলে এবং এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে ফাহিম (১৩) নগরীর বাগমনিরাম উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। মেয়ে ফাহিমা (৭) বাংলাদেশ মহিলা সমিতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেজি শ্রেণীতে পড়ে। 

সীমা আক্তার (৩০) জানান, তাঁর বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কুটুমপুরে। চট্টগ্রাম শহরে বসবাসের সুবাদে ফারুকের সাথে তাঁর পরিচয় হয় এবং ১৫ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। ফারুকের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী হলেও সেখানে থাকার মতো একখণ্ড জমিও নেই। 

মোহাম্মদ ফারুক নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার শরীয়তপুর গ্রামের মো. আবদুলের (৬৫) ছেলে। ৬ ভাই ৪ বোনের সংসারে ফারুক ছিলেন দ্বিতীয়। আবদুল এবং তাঁর ছেলেরা সবাই দিনমজুর বা ভ্যানচালক। 

স্বামী সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন সীমা আক্তার। বলেন, ‘ফারুক ছিল অমায়িক এবং অনেক ভালো একটা ছেলে। আমাদের পরিচয় হয় ১৫-১৬ বছর আগে। এরপর আমাদের বিয়ে হয়। সে গত ১৫ বছর যাবত নগরীর মুরাদপুরে শাহজালাল ফার্নিচারের দোকানে কাজ করতো। সে কখনো আমাকে কোনো কাজ করতে দেয়নি। ফারুক একা কাজ করে অনেক কষ্ট করে সংসার চালাতো। আমাকে বলতো, আমি যেন আমার ছেলে-মেয়েকে ভালোমতো পড়ালেখা করাই। ঠিকমতো স্কুলে আনা-নেয়ার কাজটি করি। কিন্তু এখন সে আর নেই।’

সীমা কথা বলছিলেন এবং তাঁর দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝরছিল। এ সময় ৭ বছরের ছোট্ট ফাহিমা মায়ের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে ছিল। 

হতাশ কণ্ঠে সীমা বলেন, ‘আজ আমার ছেলে-মেয়ে দুটি সারাজীবনের জন্য বাবা-হারা হয়ে গেল। তারা আর কখনো বাবার আদর পাবে না। এখনও পাশের বাসার কারো বাবা ডাক শুনে অনেক সময় তারা ডুকরে কেঁদে ওঠে। এখন আমাকেই সারাজীবন তাদের বাবা-মায়ের স্থান পূরণ করতে হবে।’ 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহিদ ফারুকের বাসা নগরীর লালখান বাজার পানির ট্যাংকি এলাকায়। টিনশেডের ভাড়া ঘরটি বড়জোর ১০ ফুট বাই ১০ ফুট হবে। একমাত্র কক্ষটিতে মাঝারি সাইজের একটি খাটে চার জন ঘুমাতেন। এ রকম কয়েকটি বাসার জন্য একটি কমন বাথরুম ও রান্নাঘর। দুই ফুটের মতো একটি সরু গলি দিয়ে হেঁটে ঢুকতে হয়। কিন্তু ছোট্ট এ ঘরটিই সুখের নীড় ছিল ফারুক-সীমার। একপাশের দেয়াল ঘেঁষে মাঝারি সাইজের একটি ওয়ারড্রোব আছে। পরিবারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পরিপাটি করে সাজানো। এমনকি খোলা পায়ে ঘরে ঢুকেও কোনো ময়লা-বালি দেখা যায়নি। ঘরে ঢুকেই বোঝা যায়, অতি সীমিত আয়েও বাসস্থানটিকে তাঁরা পরিচ্ছন্ন করে রাখার চেষ্টা করেছেন।  

সীমা আক্তার জানান, ‘আমার বাবা মহিলা সমিতিতে দারোয়ানের কাজ করেন। তিনি নিয়মিত আমার খোঁজখবর রাখেন। তিনি না থাকলে আমার শহরে থাকতেই কষ্ট হতো।’

সীমা জানান, ফারুকের মৃত্যুর পর তখনকার পুলিশ কমিশনার তাঁকে নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইন হাসপাতালে একটি চাকুরি দেন, আউটসোর্সিং-এর ভিত্তিতে। বর্তমানে এ আয় দিয়ে কোনোমতে তাঁর সংসার চলে। 

সীমার প্রত্যাশা, সরকার যেন তাঁর এতিম ছেলে-মেয়ে দু’টিকে ভালভাবে লেখাপড়ার করার সুযোগ করে দেয় এবং তাঁর জন্য একটি স্থায়ী চাকুরির ব্যবস্থা করে। এতে করে তিনি তাঁর অবুঝ দুই সন্তানকে বাবার লালিত স্বপ্ন লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করতে পারবেন। পরিবারটি কোনোমতে খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। 

সীমা জানান, নবনিযুক্ত বিভাগীয় কমিশনার ড. মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম ও সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলমসহ অনেকে তাঁর বাসায় এসেছেন। তাঁরা সীমার জন্য স্থায়ী চাকুরি এবং সন্তানদের লেখাপড়া ও ভরণ-পোষনের আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁদের আশ্বাসে এখন কিছুটা আশার আলো দেখছেন সীমা। বিশ্বাস করেন,

সরকারের সহযোগিতায় দুই সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত এবং সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন।