শিরোনাম
প্রতিবেদন: মোঃ মামুন ইসলাম
রংপুর, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস): সতরো বছর আগে ভালবেসে বিয়ে করেন নাজমীম ইসলাম ও দিনমজুর মেরাজুল ইসলাম। নগরীর একটি কলার দোকানে দিনমজুরের কাজ করতেন মেরাজুল (৩৬)। তার সামান্য আয় দিয়ে সুখেই চলছিল তাদের সংসার।
বিয়ের ১৭ বছর পরেও এই দম্পতির গভীর ভালবাসা ও প্রেমময় সম্পর্ক এলাকায় এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল। প্রতিবেশীরা তাদেরকে এক আদর্শ দম্পতি হিসেবে ভালবাসতেন।
গত ১৯ জুলাই ছিল নাজমীম-মেরাজুল দম্পতির ১৭তম বিবাহবার্ষিকী। এই দিনেই তৎকালীন স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পুলিশের গুলিতে স্বামীকে হারান নাজমীম(৩২)। সে থেকে এখনো কান্না থামেনি দুই পুত্র সন্তানের জননী নাজমীমের। একজন নারীর কাছে বিবাহবার্ষিকীতে স্বামীর মৃত্যু কতটা যন্ত্রণাদায়ক ও বেদনার তা হয়তো নাজমীমের চেয়ে আর বেশী কেউ জানেন না। দু’সন্তানসহ দিশেহারা নাজমীমের সামনে এখন কেবলই অন্ধকার ভবিষ্যৎ।
কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন গত ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ও অন্যতম ছাত্র সমন্বয়ক আবু সাঈদ শহিদ হওয়ার পর থেকেই রংপুরের সার্বিক পরিস্থিতি বিস্ফোরক হয়ে ওঠে।
এ অবস্থায় গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) সকাল থেকে রংপুর নগরীর অবস্থা ছিল অস্বাভাবিক রবকমের শান্ত। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায় জুম্মার নামাজের পর। হঠাৎ বিকেল তিনটা থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের বিশাল বিশাল বিক্ষোভ মিছিলে হাজার হাজার শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতা-কর্মীরা অংশ নিয়ে রাজপথে নামেন। মূহূর্তেই গোটা নগরী উত্তাল হয়ে ওঠে।
নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে বের হওয়া অসংখ্য মিছিল শাপলা চত্বর, গ্র্যান্ড হোটেল মোড়, জাহাজ কোম্পানি মোড়, পায়রা চত্বর, সুপার মার্কেট, রাজা রামমোহন মার্কেট, জেলা পরিষদ মিনি সুপার মার্কেট, সিটি মার্কেটসহ প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে শান্তিপূর্ণভাবে জিলা স্কুলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
তখন পুলিশ বাহিনীর শত শত সশস্ত্র সদস্য আর্মড পার্সোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি) নিয়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিলের বিপরীত দিক থেকে আক্রমণাত্মকভাবে ছুটে আসছিল।
বিকাল ৪টার দিকে আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনের শত শত সশস্ত্র নেতা-কর্মী ও পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়। তখন পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে রূপ নেয়।
বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে মেরাজুলের বাড়িতে চলছিল মুরগি ও পোলাও রান্নার প্রস্তুতি। নিজেদের মতো করে দিনটি উদযাপনে অনেক পরিকল্পনা ছিল দু’জনের। কিন্তু স্বৈরাচারের মাত্র একটা গুলি এই দম্পতির সাজানো সংসার তছনছ করে দিলো।
বিবাহবার্ষিকীর রাতেই নিথর দেহে ফেরা স্বামীর কথা ভেবে এখনো শোকে স্তব্ধ হয়ে আছেন নাজমীম। তিনি তার দু’সন্তানকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় ভেঙ্গে পড়েছেন।
রংপুর নগরীর নিউ জুম্মাপাড়া এলাকার মৃত সামছুল হকের ছেলে মেরাজুল ইসলাম। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। মেরাজুলের মা আম্বিয়া খাতুন (৬৫) নিউ জুম্মাপাড়ায় স্বামীর বাসায় মেয়ে রাবেয়া খাতুন (৩৮) ও স্বামীর সাথে বসবাস করেন। মেরাজুলের বড় ভাই রমজান আলী (৪০) স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক পুত্র সন্তানকে সাথে নিয়ে ঢাকায় হোটেল ব্যবসা করেন। তার ছোট ভাই দিনমজুর মোহাম্মদ মাসুম (২৫) স্ত্রীকে নিয়ে মায়ের সাথে নিউ জুম্মাপাড়ায় পৈতৃক বাসায় থাকেন।
মেরাজুল তার স্ত্রী ও দুই পুত্র সন্তানকে নিয়ে পাশ্ববর্তী আমাশু কুকরুল এলাকায় দু’শতক জমির ওপর নির্মিত টিনের চালের বাড়িতে বাস করতেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা মেরাজুল নগরীর সিটি বাজার এলাকায় পাইকারী কলা ব্যবসায়ী মহাজন জসিম উদ্দিনের কলার দোকানে একজন দিনমজুর হিসেবে তিন বছর ধরে কাজ করছিলেন। তিনি প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পারিশ্রমিক পেতেন। এর আগে তার নগরীর নিউ জুম্মাপাড়া এলাকায় পানের দোকান ছিল।
নগরীর নিউ জুম্মাপাড়া এলাকার মৃত নুরুল ইসলামের কন্যা নাজমীম ইসলাম দশম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।
এই দম্পতির তিন বছরের ছোট ছেলে মোহাম্মদ হানিফা। বড় ছেলে মেহরব হোসেন নাজিল (১৫) রংপুর সরকারী কারিগরী স্কুল ও কলেজের নবম শ্রেণির মেধাবী শিক্ষার্থী। মেরাজুলের ইচ্ছে ছিল নাজিলকে একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা।
গত ১৭ ডিসেম্বর বিকেলে বাসসের এই প্রতিবেদক শহিদ মেরাজুলের শোক স্তব্ধ বাড়িতে যান। বাড়িটিতে কোনো কোলাহল ও প্রাণ চাঞ্চল্য ছিল না। এ সময় বাড়ির বাইরে থেকে তার বড় ছেলে নাজিল তার মাকে ডেকে বলে যে একজন সাংবাদিক কথা বলতে এসেছেন।
সাক্ষাতকার নেয়ার পুরো প্রায় দু’ঘন্টা ধরে নাজমীম কাঁদছিলেন। মেরাজুল শহিদ হওয়ার পর প্রায় পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও তিনি এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।
ওই দিনের ঘটনা জানতে চাইলে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে নাজমীম বলেন, ‘অল্প আয়ের সংসার হলেও আমাদের আনন্দের শেষ ছিল না। দুই ছেলেকে নিয়ে আমাদের একটি সুখের সংসার ছিল। স্বামীর মত আমিও বড় ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচার হাসিনার একটা মাত্র গুলি আমার সাজানো সুখের সংসারটা তছনছ করে দিল। এখন আমি দুই সন্তান নিয়ে কোথায় যাব? কেমনে চালাব আমার সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ?’
নাজমীম জানান, ১৯ জুলাই প্রতিবছরের মতো এবারও তারা বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের বিষয়ে আগের রাতে কথা বলেছিলেন। প্রতিদিনের মত সেদিনও মেরাজুল সকালের নাস্তার পর তার কর্মস্থল কলার মহাজনের দোকানে যান। দুপুরে সেখানে মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করেন। এরপরে মেরাজুল একটি বড় ব্রয়লার মুরগি, পোলাওয়ের চাল, আলু ইত্যাদি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।
নাজমীম বলেন, ‘বাসায় এসে মেরাজুল আমার রান্না করা মুরগীর গোসত দিয়ে ভাত খায়। এরপরে খাটের ওপর বিছানায় হেলান দিয়ে সে আমার সাথে বিবাহবার্ষিকীর আয়োজন নিয়ে কথা বলে। একপর্যায়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে। এমন সময় আছরের আজান শুনে সে ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করে।’
ঐদিন তাদের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে নাজমীম তার বোনকে স্বামী ও সন্তানসহ দাওয়াত দিয়েছিলেন। তারাও বাসায় এসেছিল।
নাজমীম বলেন, ‘বাজার থেকে মেরাজুল বড় একটা বড় ব্রয়লার মুরগী এনেছিল। আমার ছোট ছেলে হানিফা সেটার সাথে অনেকক্ষণ খেলাও করে। এ সময় মেরাজুল মুরগীটা জবাই করে দেয়। বাজারে যাবার উদ্দেশ্যে মেরাজুল বরাবরের মত আমার হাত ছুঁয়ে তারপর বাড়ি থেকে বের হয়। কথা বলতে বলতে রাস্তায় দোকানে গিয়ে আমার বোন ও তার সন্তানদের জন্য খাবার কিনে দেয়।’
সেখান থেকেই বিকেল সাড়ে চারটার দিকে কলার দোকানের মহাজনকে টাকা দিতে মেরাজুল সিটি বাজারের দিকে রওনা দেয়।
এ সময় মেরাজুল নাজমীমকে বলেন, ‘নাজমীম, তুমি বাসায় গিয়ে রান্না শুরু করো। আমি মহাজনকে দোকানে টাকাটা দিয়েই ফিরে আসছি। রাতে একসঙ্গে খাবার খাব।’
নাজমীম বলেন, ‘মেরাজুল রওনা দেয়ার মাত্র আধাঘন্টা পরেই তার মোবাইল ফোন থেকে কেউ একজন আমাকে কল দিয়ে জানায় যে সে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। স্থানীয় লোকজন তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (আরপিএমসিএইচ) নিয়ে গেছে। আমাকে তিনি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে পরামর্শ দেন।’
পরে লোকমুখে শুনে নাজমীম জানতে পারেন যে মেরাজুল তার কর্মস্থল কলার দোকানের কাছাকাছি পৌঁছেই আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যায়। এ সময় সে পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
নাজমীম বলেন, আমি দ্রুত আমার বড় বোন নুর নাহার, বড় ভাইয়ের স্ত্রী আরিফা আখতার খুশী এবং ছোট বোন রজনীর স্বামী রিয়াজুলকে সাথে নিয়ে সন্ধ্যে ছ’টার দিকে হাসপাতালে যাই। এসময় আমার স্বামীর বড় বোন রাবেয়া খাতুনসহ আত্মীয়-স্বজনরাও হাসপাতালে পৌঁছান।
নাজমীম বলেন, ‘তখনও মেরাজুল হাসপাতালে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো অবস্থায় জীবিত ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। এ সময় চিকিৎসক কাগজে ঔষধের নাম লিখে দিয়ে দ্রুত বাইরে থেকে তা নিয়ে আসতে বলেন। আমি আমার ননদ রাবেয়া খাতুনসহ বাইরে গিয়ে সাড়ে ছয় হাজার টাকার ওষুধ কিনে হাসপাতালে ফিরে আসি। তখন অপারশেন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষমান আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা কান্না করছিলেন। আমি ভেতরে গিয়ে দেখি মেরাজুল আর নেই। আমি হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি।’
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় হাসপাতাল থেকে আমাদেরকে মেরাজুলের লাশ হস্তান্তর করে। রাত আটটায় আমাদের বাসায় লাশ নিয়ে আসা হয়।
কান্নারত নাজমীম বলেন, ‘পুলিশি চাপে লাশ আত্মীয়-স্বজনদের দেখার জন্য রাতে বাসায় রাখতে পারিনি। ঐ রাতেই নিউ জুম্মাপাড়া গোরস্থানে মেরাজুলের লাশ দ্রুত দাফন করতে বাধ্য হই।’
তিনি বলেন, ‘মিরাজুল আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল। বড় ছেলের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার কীভাবে চলবে তা আমি জানি না। কার কাছে বিচার চাইব? আমার নিরাপরাধ স্বামীকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে তাদের আদৌ কোনোদিন ন্যায় বিচার পাবো কী?’
মেরাজুলের বড় বোন রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘আমার ভাইয়ের কী অপরাধ ছিল যে গুলি করে তাকে হত্যা করতে হবে? আমি আমার ভাই হত্যার দ্রুত বিচার চাই।’
মিরাজুলের মা আম্বিয়া খাতুন বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা ছোট থাকতেই স্বামীকে হারিয়েছি। কষ্ট করে ওদের বড়ো করেছি। ঐদিন শুক্রবার মেরাজুল তার মহাজনকে টাকা দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহিদ হলো। আমার নিরপরাধ ছেলেটার হত্যাকারীদের বিচার চাই।’
নাজমীমের ছোট বোনের স্বামী রিয়াজুল ইসলাম অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে মেরাজুলের হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার ও ফাঁসির দাবী জানান। তিনি তাদের দুই পুত্রকে লালন-পালনের জন্য নাজমীমের যোগ্যতা মোতাবেক তাকে একটি সরকারি চাকুরি দেয়ার অনুরোধ জানান।
নাজমীম জানান, এ পর্যন্ত বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল রংপুরে তাদের বাড়ীতে এসে তাকে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছেন।
এছাড়াও ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাকে দেড় লাখ ও তার শ্বাশুড়ীকে ৫০ হাজার টাকা, একজন ডাক্তার ১০ হাজার টাকা, রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল ২০ হাজার টাকা এবং জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে তাকে চার লাখ ও তার শাশুড়ীকে এক লাখ টাকা দিয়েছে।