শিরোনাম
প্রতিবেদন : মাসুদ রানা
জয়পুরহাট, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার তালখুর গ্রামের শান্তিনগর এলাকার বাবা আশরাফ আলী ও মা রেহেনা বিবি’র তিন সন্তানের মধ্যে রিতা আকতার দ্বিতীয়। সংসারে অভাব অনটন। তবু রিতা দেখেছিলেন ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। লক্ষ্য ছিলো তার সংসারের হাল ধরার।
রিতা আকতার (১৭) ভাল ছাত্রী হওয়ায় এসএসসি পাশ করার পর তাকে বাবা-মা ঢাকায় নিয়ে যান। বাবা দরিদ্র রিকশাচালক ও মা বাসাবাড়িতে কাজ করেন। সংসারে অভাব।
তবু তারা মেয়েকে দোয়ারীপাড়া সরকারী কলেজে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে ভর্তি করান। রিতা’র স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হয়ে দরিদ্র মা-বাবার পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু সে আশা তার আর পূরণ হলো না।
গত ৫ আগষ্ট রিতা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে শহিদ হন। এখন বাবা-মা সন্তান হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে দিন পার করছেন।
এ ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার জন্য শহিদ রিতা আকতারের বাসায় গেলে তার বাবা আশরাফ আলী (৪৯) বাসস’কে বলেন, আমি দরিদ্র মানুষ। পেটের তাগিদে ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালাই। সেখানে আমার স্ত্রী রেহেনা বিবি (৪২) বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। আমার তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে রাকিব হোসেন (২৪) ঢাকাতেই ব্যবসা করে। মেজ মেয়ে রিতা আকতার শেওড়াপাড়ায় দোয়ারীপাড়া সরকারী কলেজে আইএ প্রথমবর্ষে পড়তো। আর ছোট ছেলে রোকন ইসলাম (১০) ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে।
ছেলেমেয়ে নিয়ে অভাব-অনটনের মাঝে তাদের সুখেই কাটছিল দিন। রিতা প্রায়ই গল্প করতো বড় হয়ে সে ডাক্তার হয়ে বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াবে।
রিতা বলতেন, ‘আমি ডাক্তার হলে সংসারে আর অভাব অনটন থাকবে না।’
জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই সামাজিক কর্মকান্ডে ঝোঁক ছিল রিতার। পড়াশোনার পাশাপাশি সুরেলা কন্ঠের কারণে মাদ্রাসার হামদ-নাত প্রতিযোগিতায় কয়েকবার প্রথম হয়েছেন।
পুরস্কার পেয়েছেন অনেক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। ২০২৪ সালে স্থানীয় ভূগোইল হেজবুল্লাহ দাখিল মাদ্রাসা থেকে বিজ্ঞান বিভাগে (৪ দশমিক ৭৮ পয়েন্টে) এ গ্রেডে পাশ করেন।
তারপরই ঢাকায় গিয়ে মিরপুর দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন।
রিতার বাবা বলেন, গত ৫ আগষ্ট সকাল ১০/১১ টার দিকে রিতা অন্যান্য বান্ধবীর সাথে আন্দোলনে যোগ দেয়। আমি দুপুরে বাসায় খেতে এসে জানতে পারি সে মিছিলে গেছে।
খাওয়া দাওয়ার পর আমি যখন বাসায় ছিলাম তখন বেলা আনুমানিক ২টার দিকে খবর পাই রিতার মাথায় গুলি লেগেছে। খবর পেয়ে আমি ও আমার স্ত্রী বিভিন্ন জায়গায় তার খোঁজ করতে থাকি। প্রথমে আমরা মিরপুর-১০ এ যাই। সেখানে সবাই বলে ছাত্ররা তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেছে। সেখানে একটি হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ করলে সেখানে না পেয়ে মিরপুর-১২ তে অন্য একটি হাসপাতালে যাই। সেখানেও তাকে না পেয়ে কুর্মিটোলা হাসপাতালে যাই। সেখান থেকে আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতালে যাই। সেখানে না পেয়ে সন্ধ্যা ৭ টার দিকে শহিদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে মেয়েকে মৃত অবস্থায় পাই। তার মাথার বাম পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে মাথার ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। সেখান থেকে মেয়েকে নিয়ে নিজের গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার তালখুর গ্রামে আসি। সেখানে পরদিন ৬ আগষ্ট তাকে দাফন-কাফন শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করি।’
এ প্রতিবেদক শহিদ রিতা’র বাসায় গিয়ে বাবা ও দুই ভাইকে পেয়েছেন। কিন্তু মা রেহেনা বিবিকে পাওয়া যায়নি। তিনি বিভিন্ন মানুষের বাসাবাড়িতে কাজের জন্য দুরে কোথাও গেছেন।
এ ব্যাপারে এলাকাবাসী কয়েক জনের সাথে কথা বললে তারা বাসস’কে জানান, রিতা আকতার ছিল খুবই নম্র ও ভদ্র স্বভাবের। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। কোনদিন এলাকার কারও সাথে খারাপ কোন আচরণ করেনি। তার বাবার নিজস্ব কোন জমাজমি কিংবা বসতভিটা নাই। এলাকার জনৈক তালেব নামে একজন তার নিজস্ব পুকুরের পাড়ে ২/৩ শতকের মত জমিতে বাসা করে থাকার জন্য দিয়েছে। সেখানেই তারা বাস করে। সরকার যদি তাদের দিকে একটু নজর দেয়, তাদের বসবাসের জন্য যদি জায়গার ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে পরিবারটা মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই পাবে।
শহিদ রিতা আকতারের ছোট ভাই রোকন ইসলাম বাসস’কে বলেন, আমার বোন রিতা দেশকে বৈষম্যমুক্ত করতে গিয়ে শহিদ হয়েছে। আর যেন আমার বোনের মত কোন রিতা’কে শহিদ হতে না হয়। আমার বোনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন যেন তার আশা দেশের মানুষকে নিয়ে পূরণ করতে পারি। আমার বোনের স্বপ্নের বাংলাদেশ তৈরী করতে পারলেই তার অত্মার শান্তি মিলবে।
এ ব্যাপারে শহিদ রিতা’র বাবার সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ৫ তারিখে সরকার পরিবর্তনের পর হতে তাদের কাছে অনেকেই এসেছেন। ঢাকা থেকে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তাদের ১ লাখ টাকা এবং স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আরো ১ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকায় কলেজের পক্ষ থেকে ৬০ হাজার টাকা, কালাই উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৪০ হাজার টাকা, বিএনপি নেতা ইব্রাহীম হোসেন ফকিরের পক্ষে ১০ হাজার টাকা, উপজেলা প্রশাসনে স্মরণসভায় ১০ হাজার টাকা, জেলা প্রশাসনের স্মরণসভায় ১০ হাজার টাকা, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা ও বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দেয়া হয়েছে।
এছাড়া জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ তাদের সাথে দেখা করে আগামীতে আরো সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক আফরোজা আক্তার বাসস’কে বলেন, আমি শহিদ রিতা’র বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে পরিবারের খোঁজ-খবর নিয়েছি।
তাকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সামান্য কিছু উপহার প্রদান করেছি। তার নাম সরকারিভাবে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আগামীতে সরকারি যে কোন সাহায্য সহযোগিতা পেলে তা দেওয়া হবে। এছাড়া শহিদ পরিবারের জন্য জেলা প্রশাসকের দরজা সবসময় খোলা আছে। যে কোন সময় যে কোন সমস্যা হলে আমাকে জানালে তা সমাধান করে দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।