বাসস
  ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১

পুলিশ হতে চাওয়া মেধাবী নাহিদ বয়ে বেড়াচ্ছেন জীবনের দুঃসহ ভার

প্রতিবেদন : আসাদুজ্জামান

সাতক্ষীরা, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪(বাসস) : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র নাহিদ হাসান। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে বাড়িতে আসেন। যোগ দেন আন্দোলনে। ছিলেন এই আন্দোলন সংগ্রামের সাতক্ষীরার একজন সমন্বয়কও।

প্রতিদিনের মতো গত ৫ আগস্টও তিনি সামনে থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ওই দিন দুপুরে দেশ ত্যাগের পরপরই আন্দোলন চলাকালীন সাতক্ষীরা শহরের খুলনা রোড মোড় এলাকার এসপি বাংলো থেকে তাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে হঠাৎ পুলিশ গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। পুলিশের ছোঁড়া নাইন.এম.এম পিস্তলের বুলেটে নাহিদ হাসানের বাম পায়ের থাই ঝাঁঝরা হয়ে যায়। একই সাথে তার ডান পায়ের থাইতেও তিনটি রাবার বুলেট ঢুকে গুরুতর আহত হন তিনি। এ সময় তার অপর এক সহযোদ্ধা জিল্লুর রহমানও পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয়রা তাদেরকে প্রথমে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও পরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে একদল বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দীর্ঘ সময় ধরে নাহিদের দুই পায়ে অপারেশন করে একটি পিস্তলের গুলি ও তিনটি রাবার বুলেট বের করেন।

নাহিদ হাসান প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু এখন তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে জীবনের দুঃসহ ভার।

নাহিদ হাসান তার নৈশ প্রহরী বাবার বাড়ি সাতক্ষীরার আলীপুরে আন্দোলনের সেই ক্ষত নিয়ে ব্যথা, বেদনা আর যন্ত্রণায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দিন পার করছেন। নাহিদের আশা ছিল ভবিষ্যতে লেখাপড়া শিখে বিসিএস শেষ করে পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ যেন নিরাশার বালি।
নাহিদ  স্বাভাবিক জীবনে আদৌ ফিরে আসতে পারবেন কি না তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। চোখে মুখে এখনও রয়েছে তার হতাশার ছাপ।

মোঃ নাহিদ হাসান (২০) সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আলীপুর চারাবটতলা এলাকার নৈশ প্রহরী মোঃ আলাউদ্দীন গাজী (৫৩) ও মোছাঃ লাভলী খাতুন দম্পতির ছোট ছেলে। তাদের বড় ছেলে মহিদ হাসান (৩২) কিশোরগঞ্জে প্রবাসী ও কল্যাণ ব্যাংকে ক্যাশিয়ার পদে কর্মরত রয়েছেন। এছাড়া তাদের মেজ ছেলে তহিদ হাসান (৩০) বর্তমানে ঢাকার সাভারে আনসার বাহিনীর এডজুটেন্ট পদে প্রশিক্ষণরত রয়েছেন। আলাউদ্দীন গাজীর গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পুষ্পকাটি গ্রামে হলেও বর্তমানে তারা সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আলীপুর চারাবটতলা এলাকায় জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি করে সেখানে বসবাস করছেন।

আহত মেধাবী ছাত্র নাহিদ হাসান বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকে আমি ঢাকার রাজপথের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে ছিলাম। আন্দোলনের এক পর্যায়ে যখন বিশ্বদ্যিালয়ের হলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন আমাদেরকে ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় সমন্বয়করা নির্দেশনা দেন স্ব স্ব এলাকায় গিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণসহ নেতৃত্ব দেয়ার।

সেই অনুযায়ী আমি বাড়িতে ফিরে আসি এবং সাতক্ষীরার প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে সামনে থেকে অংশ নেই। ছিলাম জেলার দ্বিতীয় সমন্বয়কও। প্রতিদিনের মতো গত ৫ আগস্ট সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন সড়কে আমরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ শুরু করি। একপর্যায়ে ওই দিন দুপুরে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পরপরই আন্দোলন চলাকালীন সাতক্ষীরা শহরের খুলনা রোড মোড় এলাকার এসপি বাংলো থেকে আমাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে হঠাৎ পুলিশ গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। এতে আমি ও আমার অপর এক সহযোদ্ধা জিল্লুর রহমানও ভয়াবহভাবে আতহ হই। তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয়রা আমাদেরকে প্রথমে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও পরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।  আমার দুই পায়ে অপারেশন করা হয়। একটি পিস্তলের গুলি ও তিনটি রাবার বুলেট বের করেন ডাক্তার। টানা ১০/১২ দিন সেখানে আমাকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, আমি এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। জানি না পুরোপুরি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবো কি না।

তিনি এসময় কিছুটা হতাশার সুরে বলেন, ভবিষ্যতে লেখাপড়া শিখে বিসিএস শেষ করে পুলিশ ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন ছিল আমার। আমার সেই স্বপ্ন আজ যেন কিছুটা হলেও নিরাশায় পরিণত হয়েছে। জানি না আমার ভাগ্যে কি রয়েছে।

নাহিদ হাসানের মা মোছাঃ লাভলী খাতুন সেদিনের সেই স্মৃতি মনে করে কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ছেলে আমার গত ৪ আগস্ট রাতে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আমাকে বলে, মা আমার জন্য দোয়া করিও। জানি না আগামীকাল ৫ আগস্ট জীবিত অবস্থায় তোমার কাছে ফিরতে পারবো কি না। ছেলের এই কথা শুনে আমি তাকে বললাম, বাবা তুমি না হয় আজ বাড়িতে থাকো, যাওয়ার দরকার নেই। তবু ছেলে আমার বললো, মা আমাকে যেতেই হবে। তখন আমি তাকে সাবধানে থাকার জন্য উপদেশ দিলাম। ছেলে চলে যাওয়ার পর সারারাত দুশ্চিন্তায় আমি আর ঘুমাতে পারিনি। পরদিন দুপুরের পরপরই শুনি ছেলে আমার গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর জখম হয়েছে। তাকে আনা হয়েছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

ছুটে গেলাম সেখানে। সেখানে গিয়ে আমি আমার আদরের ছোট ছেলেকে দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পালাম না। অঝোরে শুধু কেঁদেছি আর কেঁদেছি। টানা ১০/১২ দিন সেখানে কিভাবে পার করেছি তা একমাত্র মহান আল্লাহ পাকই জানেন।

তিনি এ সময় তার ছেলের জন্য সবার কাছে দোয়া চান। যাতে তার ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন।

নাহিদের বাবা নৈশ প্রহরী আলাউদ্দীন গাজী বলেন, সাতক্ষীরা শহরের অদূরে কদমতলা বাজারে দীর্ঘদিন ধরে নৈশ প্রহরীর কাজ করে সংসার চালিয়ে তিন ছেলেকে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছি। বড় ও মেজ দুই ছেলে ইতোমধ্যে লেখাপড়া শেষ করে চাকুরি করছে। আর ছোট ছেলেটা ঢাকা ভার্সিটিতে লেখাপড়া করছে। কিন্তু গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেয়ার পর পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে সে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাকে নিয়ে আমি খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছি। ব্যথা যখন বাড়ে তখন তার খুবই কষ্ট হয়।

তিনি এ সময় আক্ষেপ করে বলেন, ছেলে আমার দেশের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছে, অথচ আজ পর্যন্ত আমি সরকারি-বেসরকারিভাবে তেমন কোন সাহায্য সহযোগিতা পেলাম না।
 
তিনি এ সময় আরো বলেন, যেসব পুলিশ সদস্য আমার ছেলেকে গুলি করে গুরুতর আহত করেছে আমি আইনের আওতায় এনে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।