শিরোনাম
প্রতিবেদন: রোস্তম আলী মণ্ডল
দিনাজপুর, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ( বাসস) : আমার পুত্র আলামিন ইসলাম ওরফে সেলিম বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে দেশের জন্যে শহিদ হয়েছে। আমি আমার শহিদ পুত্রের জন্য সকলের নিকট দোয়া চাই।
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ১১ নং মরিচা ইউনিয়নের ডাবরা জিনেশ্বরী গ্রামের ৬২ বছর বয়সী ওয়াজেদ আলী কান্না জড়িত কন্ঠে এ কথাগুলো বলছিলেন।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ আলামিন ইসলাম সেলিমের পিতা ওয়াজেদ আলীর দুই ছেলে, এক মেয়ে। তিন সন্তানের মধ্যে বড়ো আলামিন ইসলাম ওরফে সেলিম (২৭), দ্বিতীয় পুত্র শাকিল ইসলাম (২৪) ও ছোট কন্যা আমেনা খাতুন (১১)।
ওয়াজেদ আলী ১৯৯৯ সাল থেকে ঢাকা সাভার উপজেলার সভাপুর এলাকায় আফা ফিল্টার কারখানায় সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে চাকরি করছিলেন। একইসময়ে ওয়াজেদ আলী তার স্ত্রী সালমা বেগম ও দেড় বছর বয়সের পুত্র সেলিমকে নিয়ে এ এলাকায় বসবাস করে আসছিলেন। এরপর এখানেই তার দ্বিতীয় ছেলে শাকিল ইসলাম ও ছোট কন্যা আমেনা খাতুনের জন্ম হয়।
সেলিম নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে বাবার সংসারের হাল ধরতে ঢাকা আমিন বাজার ব্যান্ডো ইকোফার গার্মেন্টসে অপারেটর হিসেবে চাকরি শুরু করেন। সেলিম গত ৪ বছর আগে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার শন্কা গ্রামের সামিউল ইসলামের কন্যা সুমাইয়া বেগমকে বিয়ে করেন। এ দম্পতির দু’বছর ৩ মাস বয়সের একটি শিশু সন্তান রয়েছে।
তার নাম আব্দুল্লাহ হুজাইফা। পুত্র সেলিম, পুত্রবধূসহ সকলেই একই সাথে ঢাকা সাভার সভাপুর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন।
সেলিমের ভাই শাকিল ইসলাম এসএসসি পাশ করেছে। শাকিল একটি ইলেকট্রনিক কারখানায় কাজ করে। বোন আমেনা খাতুন একটি প্রাইমারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। ছেলে, মেয়ে ও পরিবার-পরিজন নিয়ে ওয়াজেদ আলীর সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এতে ছন্দপতন ঘটে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সেলিমের যোগ দেয়া এবং অকালে তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার ঘটনায় সব ওলট পালট হয়ে যায় পরিবারটির। ওয়াজেদ আলী ও তার স্ত্রী সালমা বেগম পুত্র শোকে দিনরাত কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর, ঢাকা সাভার এলাকার মহাসড়কে আনন্দ মিছিল হচ্ছিল। সেলিমের কারখানা বন্ধ থাকায় তিনিও এ মিছিলে যোগ দেন।
হঠাৎ ওই মিছিলের ওপর আওয়ামী নেতাকর্মীরা অতর্কিত হামলা চালায়। এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও আন্দোলনে যোগ দেয়া ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। এতে অসংখ্য ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হয়।
ওই দিন সন্ধ্যার পর ওয়াজেদ আলীর কাছে একজন ফোনে সেলিমের মৃত্যুর খবর জানায়। এই সংবাদ পেয়ে ছোট ছেলে শাকিল ইসলামকে সাথে নিয়ে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে মুক্তির মোড়ে যান তিনি। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে নিহত ও আহতদের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারা পরে এনাম মেডিকেলে যান। এনাম মেডিকেলে গিয়ে দেখেন, অসংখ্য লাশ স্তুূপ করে রাখা হয়েছে। হাসপাতালের সর্বত্র রক্ত আর রক্ত। কোথাও পা দেয়ার জায়গা নেই।
তারা পিতা পুত্র মিলে এক ঘন্টা খোঁজাখুঁজি করে পরে সেলিমের মরদেহ শনাক্ত করেন। এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে সেখান থেকে শহিদ সেলিমের মরদেহ বাড়ি নিয়ে আসেন। গত ৬ আগস্ট ভোরে তারা দিনাজপুর বীরগঞ্জ উপজেলার গ্রামের বাড়ি এসে পৌঁছান। দুপুর সাড়ে ১২টায় পারিবারিক কবরস্থানে সেলিমের লাশ দাফন করা হয়।
শহিদ সেলিমের নানা বীর মুক্তিযোদ্ধা তছির উদ্দিন (৮০) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, এখনো এই বয়সে বেঁচে রয়েছি। বিধাতার কি নির্মম পরিহাস। এই অল্প বয়সে আমার নাতির অকাল মৃত্যু দেখতে হলো।
মা সালমা বেগম তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় করতে থাকেন। এর মধ্যে সেলিমের স্ত্রী সুমাইয়া জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাকে পরিবারের লোকজন জ্ঞান ফেরানোর জন্য মাথায় ও শরীরে পানি দিয়ে বাতাস করতে থাকে।
সুমাইয়ার জ্ঞান ফেরার পর তিনি বলেন, আমার আর বেঁচে থেকে লাভ কি? দু'বছর ৩ মাস বয়সের একটি শিশু পুত্রকে নিয়ে বিধবা হলাম। আমার কি অপরাধ ছিল যে, আমাকে এ ভাবে এই বয়সে স্বামী হারা হতে হলো।
তিনি বলেন, আমার স্বামীকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে, আমি তাদের বিচার চাই। আমি হত্যাকারীদের কোনদিন ক্ষমা করব না। আমার এই শিশু সন্তান এই বয়সে এতিম হয়ে গেল। আমার শিশু সন্তান আর কোন দিন তার বাবার স্নেহ ভালোবাসা পাবে না। এই এতিম সন্তানটির কি হবে, কে তাকে দেখবে, আমি একজন মেয়ে মানুষ, আমার পক্ষেই বা কি করার আছে? এসব কথা বলে সবার কাছে সে জবাব জানতে চায়।
কিন্তু এসব প্রশ্নের কি জবাব দেয়া যায়। আত্মীয়-স্বজনরা তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
এদিকে ওয়াজেদ আলী বাধ্য হয়ে বর্তমানে পরিবার পরিজন নিয়ে গ্রামে বাস করছেন।
ওয়াজিদ আলী বলেন, আমার থাকার মত গ্রামে শুধু ৪ শতক জমির ওপরে দুটি ঘর রয়েছে। আমার নিজের আর কোন জমি জমা নেই। পুত্র সেলিম শহিদ হওয়ার পর থেকে, আমি ও আমার স্ত্রী শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। ভারি কোন কাজ কর্ম করতে পারি না। ছোট পুত্র শাকিল ইলেকট্রনিক মিস্ত্রির কাজ করে কোন রকমে সংসার চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, সেলিমের স্ত্রী সুমাইয়া বেগম এই অবস্থায় তার শিশু সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে রয়েছেন। আমার পরিবারটা এলোমেলো অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ছোট মেয়ে আমেনা খাতুন সাভারের একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তো। এই ডিসেম্বর মাসে তার বার্ষিক পরীক্ষা হতো। গ্রামে থাকার কারণে তার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে আমার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতাহারুল ইসলাম চৌধুরীকে বলার পর তিনি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
বীরগঞ্জ উপজেলা জামাতের আমীর মাওলানা মোঃ খোদাবক্স দলের পক্ষ থেকে তাদের এক লক্ষ টাকা দিয়েছেন বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, আমি ওই টাকা থেকে আমার শহিদ পুত্র সেলিমের স্ত্রী সুমাইয়া বেগমকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। গত ২৫ দিন আগে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন থেকে ৫০ হাজার টাকা এবং গত ২৮ নভেম্বর দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের পক্ষ হতে ২৫ হাজার টাকা সাহায্য প্রদান করেছে। আমার ছেলের বউকে এলাকার সকলেই পরামর্শ দিয়ে কলেজে ভর্তি করে দিয়েছে। তাকে লেখাপড়া শেষ করে একটি কাজে দেওয়ার জন্য এলাকার নেতারা সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন।
মা সালমা বেগম বলেন, আমরা গরীব মানুষ। প্রায় ৩০ বছর যাবত আমরা ঢাকা সাভারে কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছি। আমার ছেলে সেলিম আন্দোলনে অংশ নিয়ে অকালে জীবন দিয়েছে। তাকে হারানোর শোক আমরা এখনো সামলে উঠতে পারিনি।
তিনি অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে পুত্র হত্যার বিচার দাবি করেন।
শহিদ সেলিমের ছোট ভাই শাকিল ইসলাম বলেন, আমরা সাভার এলাকায় পরিশ্রম করেই আমাদের জীবন চালাচ্ছিলাম। কিন্তু সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। আমার ভাই দেশের জন্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে শহিদ হয়েছে। এটা আমি গর্ব করে বলতে পারি।
বীরগঞ্জ উপজেলার ১১ নং মরিচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতাহারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমার এলাকার দরিদ্র ওয়াজেদ আলী, তার পরিবার নিয়ে ঢাকা সাভারে কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। তার পুত্র সেলিম শহিদ হয়েছে। কিন্তু ঢাকা সাভারে সন্ত্রাসীদের কারণে তারা বসবাস করতে পারছে না ।
তিনি বলেন, যারা ওয়াজেদ আলী ও পরিবারের ক্ষতি করতে চায়, ওই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।