শিরোনাম
প্রতিবেদন: বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : মিরাজ শরিফের জীবনটা গত ১৯ জুলাই দুপুর পর্যন্ত স্বাভাবিকই ছিল। পেশায় তিনি উবার চালক। যা আয় হতো তা দিয়েই চলতো সংসার।
তার পরিবারে সদস্য সংখ্যা ছয়।
আহত হওয়ার পর গত পাঁচ মাস ধরে মিরাজ শরিফের (৪৫) কোন আয়-রোজগার নেই। তার স্ত্রী রূপা খানম (৩৫) তিন সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে যেন অকূল সাগরে পড়েছেন।
দিশেহারা মিরাজ নিজেও। কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
রূপা খানম বলেন, ‘ওর জন্য (মিরাজ) প্রতিদিন ১৫০০ টাকার ওষুধ লাগে। বাসা ভাড়া, দুই মেয়ের পড়ার খরচ, আবার ছয়জন মানুষের খাওয়ার খরচ। কীভাবে চলে এ সংসার?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রূপা বলেন, ‘আগে মিরাজ গাড়ি চালাতো। যা আয় করতো তা দিয়েই সংসার চলতো। এখন পাঁচ মাস হলো কোন কাজ করতে পারে না। পরিবারের কারো কোন আয় নেই। কিন্তু খরচ তো হচ্ছেই। এ নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি। আমার পরিবারের কি হবে? কীভাবে চালাবো স্বামীর চিকিৎসার খরচ? ঋণই বা কীভাবে শোধ করব?’
তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে মিরাজের শরীরে চারবার অপরেশন হয়েছে। আগামী ১২ জানুয়ারি আবার সিএমএইচে ভর্তি হতে বলেছেন চিকিৎসকরা। আর একবার অপারেশন করতে হবে। মিরাজের পেটে গুলি লাগার কারণে খাদ্যনালী ফেটে গেছে। কোন খাবার হজম করতে পারে না। তাই পেট কেটে আলাদা মলদ্বার তৈরি করে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এছাড়াও পেটের ভেতরে চার জায়গায় নাড়ি ছিঁড়ে গেছে।’
সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁওয়ের নিকেতন বাজার গেটের বাসায় বাসসের প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে সীমাহীন যন্ত্রণার কথা জানাতে গিয়ে মিরাজ শরিফ ও তার স্ত্রী রূপা খানম কান্নায় ভেঙে পড়েন।
মিরাজ শরিফের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে মারজুবা আক্তার (১৯)। সে তেজগাঁও মহিলা কলেজ থেকে আগামী বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। ছোট মেয়ে অলিভা আক্তার বৃষ্টি মহাখালী মডেল হাইস্কুল থেকে আগামীবছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। এছাড়া চার বছর বয়সী ছেলে আল হাবিব এবং মা ফিরোজা বেগমকে (৬৫) নিয়ে দুঃসহ স্মৃতি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে মিরাজের পরিবার। মিরাজের বাবা সাইদুল শরিফ গত ৬ বছর আগে মারা গেছেন।
মিরাজ শরিফের বাড়ি বরিশাল সদর উপজেলার ২৩ নং ওয়ার্ডের পশ্চিম সাগরদী, গাবতলার টিয়ারখালী রোডে। স্ত্রী, তিন সন্তান, অসুস্থ মাকে নিয়ে তাঁর সংসার। পরিবারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অথচ এখন ঘরবন্দী। চিকিৎসার খরচ আর সংসার চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তাদের।
ঘটনার বিবরণে মিরাজ বলেন, ১৯ জুলাই আমার এক পরিচিত জন ফোন করে গাড়ি ভাড়া নিতে চান। তখন ভাড়া নিয়ে কথা বলতে আমি নামাজ শেষ করে নাস্তা খেয়ে মহাখালি কলেরা হাসপাতালের সামনে যাই, সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় দিকে। সে সময়ে সেখানে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়া ছাত্র ও পুলিশের মাঝে ধাওয়া পালটা ধাওয়া চলছিল। এক পর্যায়ে পুলিশের ধাওয়ায় ছাত্রদের মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এমন সময়ে একটা গুলি এসে আমার পেটে লাগে। তখন আমি আতঙ্কে দৌড়াতে থাকি। কিছুটা দৌড়ানোর পরে রাস্তায় পড়ে যাই। আন্দোলনরত ছাত্ররা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন অনেক রক্ত ঝরছিল। কিন্তু কোন হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে আমার পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা মিলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়।
মিরাজ আরো বলেন, ‘গুলিতে আমার খাদ্যনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পেটের নাড়ি চার জায়গায় ছিঁড়ে যায়। পরে ২০ জুলাই সকাল ১০ টায় আমার শরীরে অপারেশন হয়। কিছুদিন ঠিক ঠাক মতই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে গত ১২ সেপ্টেম্বর সিএমএইচে ভর্তি হই। এখন আমি ছয় সপ্তাহের বিশ্রামে আছি। আবার আগামী ১২ জানুয়ারি ভর্তি হবো। তারপর আমার শরীরে পঞ্চম অপারেশন হবে।’
তিনি বলেন, ‘অপারেশন হলে কি হয়, কে জানে। আমার কিছু হলে, আমার পরিবারের কি হবে? যে অবস্থা হয়েছে চিকিৎসকরা বলেছেন, আমার খাদ্য নালী জটিল আকার ধারণ করেছে। অপারেশন করলে ভালো হবে কি না জানি না। আমার জন্য দোয়া করবেন।’
মিরাজ আহত হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে তা নিয়ে স্ত্রী রূপা খানম বলেন, ‘মহাখালি থেকে মিরাজকে নিয়ে যখন ঢাকা মেডিকেলে যাবো তখন কোন গাড়ি পাচ্ছিলাম না। অনেক গাড়িচালকের পায়ে ধরেছি। কিন্তু কেউ যেতে রাজি হয়নি। পরে কিছু রাস্তা রিকশায়, কিছু রাস্তা সিএনজিতে করে হাসপাতালে নিয়ে গেছি। ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে আবার ঝামেলায় পড়ি। প্রথমে হাসপাতালে ভর্তি নেবে না বলে জানায়। পরে চিকিৎসকদের হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করার পরে তারা ভর্তি নিতে রাজি হন।’
তিনি বলেন, আমার স্বামীর চিকিৎসা করাতে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ঋণ হয়েছে। এ ঋণ শোধের তাড়া আছে। এছাড়া প্রতিমাসে বাসা ভাড়া দিতে হয় ২১ হাজার টাকা।
মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ। সব মিলিয়ে খুব সমস্যায় দিন কাটছে আমাদের। তবে সিএমএইচে চিকিৎসা করাতে কোন টাকা খরচ হচ্ছে না। কিন্তু সব ওষুধ তো তাদের কাছে সব সময় থাকে না। সেটা বাইরে থেকে আনতে হয়। আবার আমাদের হাসপাতালে যাওয়া-আসায় টাকা লাগে। রোগীর খাবার কিনতে হয়। সব মিলিয়ে প্রতিদিন ১৫০০ টাকা লাগে।
সহযোগিতার মধ্যে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫০ হাজার টাকা পাওয়ার কথা জানান রূপা।
দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে আহত মিরাজের মা ফিরোজা বেগম বলেন, ছেলেটাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি। ওর ভবিষ্যত কি হবে? আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। ও যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। তার অনেক স্বপ্ন সন্তান তিনটাকে লেখাপাড়া শেখানোর। আমাদের যেন কারো কাছে হাত পাততে না হয়। আমার ছেলে যেন কাজ করে খেতে পারে। এ দোয়া করবেন সকলে।