শিরোনাম
প্রতিবেদন : মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন
ফেনী, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : আবদুল মালেক একজন রিকশা চালক। তার ছেলে সবুজও বড় হয়ে একই কাজে জড়িয়ে যান। সাইফুল ইসলাম সবুজ। বয়স ২২ বছর।
তিনি টমটম (ব্যাটারিচালিত রিকশা) চালিয়ে বাবার সাথে সংসারের উপার্জনে যোগ দেন।
চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে সবুজ ছিলেন দ্বিতীয়। বড় ভাই ইউসুফ আলী স্বপনও রিকশা চালক। ৪ আগস্ট সরকার বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে সবুজ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি। ফেনী শহরের সার্কিট হাউজ সংলগ্ন ভাড়া বাসার পাশে গ্যারেজে রিকশা রেখে যোগ দেন মহিপালে ছাত্র-জনতার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে।
সবুজের বাবা আবদুল মালেক(৫৫) জানান, ছেলের সঙ্গে তার শেষ দেখা হয় সকাল ১০টার দিকে। তখন সবুজ রিকশায় যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন। বাবাও তখন যাত্রী নিয়ে মালেক মিয়ার বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। সকাল ৮টার দিকে বের হওয়ার সময় সবুজ বাবা-মাকে দুপুরে একসঙ্গে বাসায় খাওয়ার কথা বলে গিয়েছিলেন।
তবে কাছাকাছি বড় ভাই স্বপনের বাসায় ১০টার কিছু পর এসে দুই ভাই একপ্লেটে পান্তা ভাত খেয়েছিলো বলে জানান আবদুল মালেক।
সবুজের বড়ো ভাই ইউসুফ আলী স্বপন বলেন, ‘বেলা ২টার দিকে মহিপালে গণ্ডগোলের খবর পেয়ে আশপাশে খোঁজখবর নিই। সবুজ কোন দিকে গেলো কোন খোঁজ পাচ্ছি না।
তার মোবাইলে অনেকবার রিং বাজলেও কেউ ধরছিল না। টেনশন বেড়ে যাচ্ছিলো। শুনেছি, মহিপালে আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে অনেক মানুষ মারা গেছে। কিন্তু সে আন্দোলনে গেছে কি না আমাদের জানা ছিল না। একপর্যায়ে আসরের নামাজের পর একজন আমাকে মোবাইল ফোনে ছবি দেখিয়ে বলে- এটি আমার ভাইয়ের কী না।
আমি ছবি দেখে চিনে যাই। তখন জানতে পারি আমার ভাই আর নেই। সবুজের লাশ ফেনী সদর হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে। এর আগে আড়াইটা পর্যন্ত তার লাশ মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে পড়েছিল। পরে কয়েকজন ছাত্র তাকে উদ্ধার করে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
স্বপন জানান, সবুজের পিঠে গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়। ওইদিন রাতেই তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার দক্ষিণ টুমচর চর গাজী গ্রামে। সেখানে তাকে দাফন করা হয়।
সবুজের বাবা আবদুল মালেক জানান, ছোট বেলায় তিনি লক্ষ্মীপুর ছেড়ে কাজের সন্ধানে ফেনী চলে আসেন। এখানেই বড় হন, বিয়ে করেন। সার্কিট হাউজ সংলগ্ন বিজয়সিংহে ভাড়া বাসায় থাকেন। ছেলেকে হারিয়ে তিনি পাগলপ্রায়। তার স্ত্রী শাহনাজ বেগমও (৪৫) ছেলের শোকে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পাঁচ মাস হয়ে গেলো। এখনও তার কান্না থামেনি। চোখে ঝাপসা দেখেন। বড় ছেলে স্বপন আর ছোট ছেলে রাসেল মায়ের কাছেই থাকে। সবুজের কাপড়চোপড় তার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তবুও সবুজের একটা প্যান্ট হাতের কাছে পেয়ে তা জড়িয়ে বিলাপ করেন। জায়নামাজে বসে গভীর রাতেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন।
মালেক বলেন, ‘গত ৪ আগস্ট দুপুরে তিনি (শাহনাজ বেগম) জোহরের নামাজ পড়ার সময় তিনবার সূরা পড়তে ভুল করেন। দুপুর থেকে তিনি হা হুতাশ করতে থাকেন।
কিন্তু কোথায় কী হয়েছে তখনো বলতে পারছেন না। সন্ত্রাসীদের নির্বিচার গুলিতে তার যে নাড়িছেঁড়া ধন চিরদিনের জন্য চলে গেছে তখনো তিনি জানতেন না।’
আবদুল মালেক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ও সবুজের মায়ের মতো অনেকেই কানতেছে। আমাদের ছেলে দেশের জন্য শহিদ হয়েছে। দেশকে জালিমদের হাত থেকে উদ্ধার করেছে। আমরা চাই দেশটা যেন ভালো চলে।’
এদিকে সবুজের হত্যার ঘটনায় বড় ভাই ইউসুফ আলী স্বপন বাদি হয়ে ফেনী মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। দাফনের এক মাস পাঁচদিন পর তার লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করা হয়। ইতোমধ্যে ১৮ থেকে ২০ জন গ্রেফতার হয়েছে বলে স্বপন জানান।
তবে ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে তিনি আক্ষেপ করেন।
তিনি বলেন, মহিপালের গণহত্যায় জড়িতরা অনেকে ইতোমধ্যে দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। ঘটনার পর পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্তরিক হলে খুনিরা পালিয়ে যেতে পারতো না। নতুন পুলিশ সুপার মো: হাবিবুর রহমান তাদের আশ্বস্ত করেছেন, দ্রুতসময়ের মধ্যে খুনীরা আইনের আওতায় আসবে।
স্বপন জানান, ইতোমধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার নূর মোহাম্মদ আজমীসহ অনেকে তাদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। নতুন জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম সাক্ষাত করে তাদের পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমার ভাই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। ভাইকে আর ফিরে পাবো না। তবে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভাইকে স্মরণীয় করে রাখতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। দেশ যদি আগের মতো চলে তাহলে এতো লোক শহিদ হয়ে লাভ কী !’