শিরোনাম
প্রতিবেদন: মোঃ মামুন ইসলাম
রংপুর, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনীর ছোঁড়া মাত্র একটি বুলেটে স্বামী সাজ্জাদ হোসেনকে হারালেন জিতু বেগম। এখন তিনি পাঁচ বছরের কন্যা সিনহাকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শংকায় দিন কাটাচ্ছেন।
সাজ্জাদ হোসেন (২৭) ছিলেন রাস্তার ধারের মৌসুমি শাকসবজি ও ফল বিক্রেতা। এ সামান্য উপার্জনে তারা সুখেই জীবনযাপন করছিলেন। একমাত্র মেয়েকে সঠিকভাবে শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা ছাড়া তাদের আর কোনো তেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না।
তবে সব হিসাব নিকাশ পাল্টে যায় গত ১৯ জুলাই। এ দিন রংপুর সিটি মার্কেটের সামনে ওভার ব্রিজ পয়েন্টের কাছে অদম্য বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে সাজ্জাদ শহিদ হন।
কাঁদতে কাঁদতে জিতু বেগম (২৩) প্রায়ই প্রশ্ন করেন, ‘কীভাবে আমাদের মেয়ে সিনহাকে মানুষ করব? আমি কীভাবে সিনহাকে বোঝাব যে তার বাবা কখনই ফিরে আসবে না। সে জেগে থাকে তার বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর আশায়।’
রংপুর নগরীর কামাল কাছনা এলাকায় সম্প্রতি বাসসের সাথে আলাপকালে শহিদ সাজ্জাদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা তার সাথে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা এবং পরবর্তী পরিস্থিতির বর্ণনা দেন।
তারা জানান, সাজ্জাদের বাবা ইউসুফ আলী পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। তার বিধবা মা ময়না বেগম (৫৬) শারীরিক দূর্বলতা, অনিদ্রা, নিম্ন রক্তচাপ ও অপুষ্টিসহ নানা রোগে ভুগছেন। ইউসুফ আলী ও ময়না বেগমের তিন মেয়ে ও দুই ছেলেসহ মোট পাঁচ সন্তান।
বাবা-মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সাজ্জাদ হোসেন ছিলেন চতুর্থ। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় দারিদ্র্যের কারণে সাজ্জাদকে লেখাপড়া শেষ করতে হয়।
সাজ্জাদ ও তার ছোট ভাই সাফিনের পরিবার তাদের মা ময়না বেগমের সাথে টিনের ছাদের দুই রুমের ছোট্ট বাড়িতে একটি করে রুম ভাগ করে আলাদাভাবে বসবাস করে।
সাত বছর আগে ২০১৭ সালের ১৭ নভেম্বর সাজ্জাদ জিতু বেগমকে বিয়ে করেন। তাদের একমাত্র কন্যা জাহ্নবী আখতার সিনহা সবেমাত্র বিসমিল্লাহ একাডেমি মাদ্রাসায় প্লে-গ্রুপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সে শীঘ্রই সেখানে নার্সারি গ্রুপে ভর্তি হবে।
শহিদ সাজ্জাদ মৌসুমী বিক্রেতা হিসেবে ভ্যান গাড়িতে করে শহরে সবজি বা ফল বিক্রি ছাড়াও রাজমিস্ত্রির সাহায্যকারী হিসেবেও কাজ করতেন। জিতু বেগম দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তার বাবা জাহাঙ্গীর আলম (৬০) রংপুর শহরের মাহিগঞ্জ সাতমাথা এলাকার আনসারির মোড়ের একজন সাইকেল মেরামতকারী হিসেবে কাজ করেন। তার দুই বোন ও এক ভাই আছে।
গত ১৯ জুলাই স্বামী সাজ্জাদের শহিদ হওয়ার ঘটনা বর্ণনায় জিতু বেগম বলেন, সাজ্জাদ সকালে রংপুর সিটি মার্কেটে যান। পরদিন শহরে বিক্রি করার জন্য সেখান থেকে বিভিন্ন প্রকার সবজি কিনে বাড়িতে আসেন।
তিনি বলেন, ‘সেদিন ছিল শুক্রবার। আমি আমার বাবার বাড়িতে ছিলাম। জুমার নামাজ পড়ার পর সাজ্জাদ একটি হোটেলে দুপুরের খাবার খায়। রাতে নগরীর সিগারেট কোম্পানির মোড় এলাকায় আমাদের একটি বিয়ের দাওয়াতে যাওয়ার কথা ছিল।’
জিতু বলেন, ‘দুপুরে সাজ্জাদ আমাকে বলেছিল যে সন্ধ্যায় সে আমাকে আমার বাবার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবে। এটাই ছিল আমাদের মাঝে শেষ কথোপকথন।’
এ সব কথা বলার সময় পাশাপাশি বসা জিতু ও তার শাশুড়ি ময়না বেগম কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন।
জিতু কাঁদতে কাঁদতে আরো বলেন, ‘তোমাকে (সাজ্জাদ) ছাড়া আমার মেয়ে, অসুস্থ শাশুড়ি ও এতিম ভাগ্নি জুঁই (৯)-কে নিয়ে আমার সংসার চলবে কী করে? কে আমার মেয়ের জন্য নাস্তা আনবে আর তার মাদ্রাসা শিক্ষার খরচ বহন করবে? ’
এসময় সেখানে উপস্থিত থাকা সাজ্জাদের দুলাভাই আলী হোসেন বাসসকে জানান, গত ১৯ জুলাই জুমার নামাজ আদায় করে একটি হোটেলে দুপুরের খাবার খায় সাজ্জাদ। এরপর, বাড়িতে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে সে বিকেল চারটার দিকে সিটি মার্কেটে যায়।
আলী বলেন, ‘সাজ্জাদ সিটি মার্কেটের ভেতরে আটকা পড়ে যায়। কারণ মার্কেটের বাইরের পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান উদ্ধৃত করে আলী বলেন, ‘এক পর্যায়ে সাজ্জাদ সিটি মার্কেটের ভেতরে তার সবজি রেখে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেয়।
এদিকে পুলিশ এপিসি গাড়ি থেকে মিছিলে গুলি চালায় এবং রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড এবং টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুরো এলাকায় একটি ভীতিকর ও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
তিনি বলেন, ‘পরে খোঁজ-খবর নিয়ে আমি জানতে পেরেছি যে রংপুর সিটি করপোরেশনের গেট থেকে পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে ঠিক রাস্তার অপর প্রান্তে ওভার ব্রীজের পাশে পরপর চারজন নিহত হয়েছে। এই চারজন শহিদের মধ্যে সাজ্জাদ ছিল চতুর্থ।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি প্রথম খবর পাই বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে যখন কেউ আমাকে সাজ্জাদের মোবাইল থেকে ফোন করে জানায় যে তাকে পুলিশ গুলি করেছে। ফোনকারী আমাকে লাশ সংগ্রহ করতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেয়।’
আলী বলেন, ‘পরে আমি আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে হাসপাতালে যাই। রাত নয়টার দিকে লাশ নিয়ে ফিরে আসি। এ সময় সেখানে কান্নার রোলে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাজ্জাদের শরীর ধোয়ার সময় আমি দেখতে পেলাম একটি গুলি তার কোমর ও বগলের মাঝখানে পাঁজরের খাঁচার ডান দিক দিয়ে প্রবেশ করেছে। এটি আড়াআড়িভাবে তার শরীর ভেদ করে অপর দিকের বাম হাতের হাড় ভেদ করে বেরিয়ে গেছে।’
পরদিন ২০ জুলাই সকাল ১০টায় কাছের মাদ্রাসায় সাজ্জাদের নামাজে জানাজা শেষে সকাল ১১টায় শালবন মিস্ত্রিপাড়া কবরস্থানে মরদেহ দাফন করা হয়।
কেউ শহিদ সাজ্জাদের বাড়িতে গেলে নিষ্পাপ শিশু সিনহার মায়াবি মুখের দিকে তাকিয়ে আবেগে ঠিকমত কথা বলতে পারবেন না। পরিবারটিতে এখন এক অস্বাভাবিক শান্ত
পরিবেশ বিরাজ করছে। সকলেই সিনহার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। স্বামীকে হারিয়ে জিতুও বাকরুদ্ধ। শোকে স্তব্ধ সবাই।
সিনহার একটি প্রশ্নে সবাই থমকে যায়। শিশুটি তার বাবা সাজ্জাদকে খুঁজছে।
সিনহার প্রশ্ন ‘বাবা কবে বাড়ি আসবে?’ কিন্তু এর উত্তর কেউ দিতে পারে না।
জিতু বলেন, তাদের মেয়ে সিনহা রাতে জেগে থেকে বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর অপেক্ষায় থাকে। সিনহা বিশ্বাস করে যে তার বাবা বাইরের কাজ সেরে বাড়ি ফিরে তাকে জড়িয়ে ধরবেন। তার কপালে আগের মতোই আদর করে চুমু দেবেন।
জিতু আরো বলেন, ‘সিনহার বিশ্বাস তার বাবা দোকান থেকে সকালের নাস্তা কিনবেন এবং তাকে আগের মতোই হাত ধরে হেঁটে হেঁটে পাশের তার মাদ্রাসায় নিয়ে যাবেন। সেই আশা নিয়েই বাবার জন্য অপেক্ষা করছে সিনহা। গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে।’
শহিদ সাজ্জাদের স্ত্রী, একমাত্র মেয়ে, মা এবং নয় বছরের ভাতিজি জুঁই সহ পাঁচ সদস্যের একটি ছোট সুখী পরিবার ছিল। উপার্জনক্ষম ছিলেন শুধু সাজ্জাদ।
সাজ্জাদের মা ময়না বেগম বলেন, আমার ছেলে ব্যবসার জন্য সবজি আনতে বাজারে গিয়েছিল। পরে আন্দোলনে যোগ দিয়ে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরল। সাজ্জাদের টাকায় আমাদের সংসার চলত। এখন সংসার কিভাবে চলবে জানি না।
তিনি বলেন, ‘আমার নাতনি সিনহা সবসময় বাবার জন্য কাঁদে। আমার ছেলে তার মেয়েকে খুব ভালবাসত। সে কখনই তার বাবাকে ছাড়া ঘুমাত না।’
ময়না বেগম তার পুত্রবধূ জিতু বেগম ও সিনহাকে তাদের বেঁচে থাকার জন্য সহযোগিতা করতে অন্তবর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
জিতু বেগম জানান, এ পর্যন্ত বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল তাদের বাড়িতে এসে তাকে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এছাড়াও, জামায়াতে ইসলামী দুই লাখ টাকা, রংপুর সিটি করপোরেশন থেকে ৫০ হাজার টাকা, রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল ২০ হাজার টাকা এবং জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে।
গত ১৯ জুলাই স্বামী সাজ্জাদের শাহাদাতের পর ফ্যাসিবাদী শাসনামলে জিতু বেগমকে যে তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল তার বর্ণনা দিয়ে তিনি তার স্বামীর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য অন্ত:বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আমি অন্ত:বর্তীকালীন সরকারকে আমার মেয়ে সিনহা, অসুস্থ শাশুড়ি ময়না বেগম এবং ভাগ্নি জুঁইয়ের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করছি।’
তিনি আরো বলেন, তার স্বামী শহিদ সাজ্জাদ জাতিকে ফ্যাসিবাদ ও বৈষম্য থেকে মুক্ত করতে গিয়ে বীরত্বের সাথে তার জীবন উৎসর্গ করেছেন। এজন্য তিনি গর্বিত। ’