শিরোনাম
প্রতিবেদন: বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ১ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী এস এম সারফুউদ্দিন গত ৫ আগস্ট রাতে এশার নামাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন। কে জানত কিছু পরেই পুলিশের গুলিতে তার জীবনপ্রদীপ নিভে যাবে, বাসায় ফেরা হবে না আর কোনদিনই !
তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে তার ছিল সুখের সংসার। বড় মেয়ে সুমাইয়া উদ্দিন শিফা (২৩) অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। সারফুউদ্দিনের ঠিক করে যাওয়া ছেলের সাথে সম্প্রতি বিয়ে হয়ে সিফার। ছোট মেয়ে সানজিবা উদ্দিন শিখা (১৭) এসএসসি পরীক্ষার্থী। আর সবার ছোট ছেলে সিয়াম উদ্দিন সৌরভ (১৩) মাদ্রাসায় পড়ছিল।
বাবার মৃত্যুর পর অর্থের অভাবে তাদের লেখাপড়া এখন বন্ধ।
একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির মৃত্যুতে সংসারে নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা। সন্তানদের নিয়ে সারফুউদ্দিনের বিধবা স্ত্রী সেলিনা খাতুন (৫১) চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন। ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ কি? কে দেবে এর জবাব ?
রাজধানীর বংশাল হাজী আব্দুল্লাহ সড়ক লেনের বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসের প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমন কথা জানান বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে রাজধানীর বংশাল চৌরাস্তায় (নর্থসাউথ রোড) পুলিশের গুলিতে নিহত ব্যবসায়ী এ এম সারফুউদ্দিনের(৫৫) স্ত্রী সেলিনা খাতুন।
তিনি বলেন, ‘পরিবারে আমার স্বামী ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তিন সন্তানের পড়ালেখা থেকে শুরু করে সংসারের সব খরচ তিনিই চালাতেন। আমি গৃহিণী। এখন কীভাবে সংসার চলবে কিছুই বুঝতে পারছি না। এতিম সন্তানদের দায়িত্ব কে নেবে ?’
সেলিনা খাতুন বলেন, ‘বড় মেয়ে সুমাইয়ার বিয়ে ঠিক করেছিলেন ওর বাবা। ঋণ করে কিছুদিন আগে মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন তার বাবা চলে যাওয়ায় আমি অন্ধকারে ডুবে গেছি। কিভাবে চলবে সংসার, কিভাবে মেয়ের বিয়েতে করা ঋণ শোধ করবো?দুশ্চিন্তায় কাটে দিন।’
ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। এরপর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ভারতে। এ খবর শোনার পর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে লাখ লাখ ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষ উল্লাস শুরু করে। তবে সারাদেশব্যাপী যখন চলছে বিজয় উৎসব, তখনও বংশাল চৌরাস্তায় চলছে পুলিশ ও সাধারণ জনতার মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং গোলাগুলি।
এর একপর্যায়ে বংশালে গুলিতে নিহত হন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী এস এম সারফুউদ্দীন(৫৫)। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে অকূলপাথারে পড়েছেন শহিদ এস এম সারফুউদ্দিনের স্ত্রী সেলিনা খাতুন।
সারফুউদ্দীনের বাড়ি পুরান ঢাকার লালবাগ থানার আব্দুল আজিজ লেনে। কিন্তু পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন বংশালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ষাট-সত্তর দশকে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন বেশ বিখ্যাত ছিল। শরীফ মিয়া তখন ছিলেন সুপরিচিত মুখ। ব্যবসায়ী সারফুউদ্দীন তারই ছেলে।
সারফুউদ্দীন বংশাল এলাকায় নুর ট্রেডার্স নামের একটি দোকান চালাতেন। সেখানে কাঠের বিভিন্ন ডিজাইনের দরজা-জানালা বিক্রি করতেন। সারফুউদ্দিন ৫ আগস্ট শহিদ হন। তাকে ৬ আগস্ট দুপুরের দিকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সে দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শহিদ সারফুউদ্দীনের স্ত্রী সেলিনা বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ভেবেছিলেন সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আর গুলি হবে না কোথাও। কিন্তু সেই রাতেও গুলি হলো। খবর শুনে ছুটে যাই বংশাল চৌরাস্তায়। সেখানে গিয়ে শুনি আমার স্বামীর লাশ ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। আমার ভাইকে সাথে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যাই। গিয়ে দেখি স্বামীর নিথর দেহ পড়ে আছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমি রাজনীতি করিও না, বুঝিও না। আমরা সাধারণ মানুষ। স্বামীকে হারিয়েছি। এ জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ সরকার। আমি শেখ হাসিনার বিচার চাই।’
এদিকে পরিবারটি সারফুউদ্দীনের মৃত্যু সনদপত্রের জন্য এখন লড়াই করছে। সনদের জন্য পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে ধর্ণা দিচ্ছেন। কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক বরাবর মৃত্যুসনদ চেয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর দরখাস্ত করা হলেও তাতে কোন কাজ হয়নি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে শহিদ সারফুউদ্দীনের স্ত্রী সেলিনা খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামীর মৃত্যু সনদ বিশেষ প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষ তা আমাদের দিচ্ছে না। ওরা বলে ভর্তির সিরিয়াল নম্বর প্রয়োজন। কিন্তু ভর্তির সময় আমার স্বামীর গায়ে লাগানো সিরিয়াল নম্বরের স্টিকারটি রক্তে ভিজে যায়, তাই সেটা সংগ্রহে রাখতে পারিনি। আর আমার স্বামীর গুলি লাগছে, সে মারা যাচ্ছে, তখন কি ওই কাগজ সংগ্রহের বিষয় মাথায় থাকে? ৫ তারিখের রেজিস্টার খাতা দেখলেইতো হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের বারবার হয়রানি করা হচ্ছে। আমি সরকারের প্রতি আহবান জানাবো আমার স্বামীর মৃত্যু সনদ দেওয়ার যেন ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও আমরা এখনও সরকারের কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাইনি। সরকার যদি কোন ব্যবস্থা না করে তাহলে আমাদের পথে বসতে হবে।’
সারফুউদ্দীনের সন্তানরাও চান তাদের বাবার হত্যাকারীদের বিচার হোক। ছোট মেয়ে সানজিবা উদ্দিন শিখা বলেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালানোর খবর শুনে আমরা আনন্দ মিছিল করি। টিএসসি, শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়াই। আনন্দ মিছিল থেকে বাসায় ফিরে আব্বুর সাথে খাওয়া-দাওয়া করি।
পরে আব্বু এশার নামাজ পড়তে বের হন। রাত ৯ টার দিকে খবর পাই বাংলাশ মোড়ে আব্বুর গুলি লাগছে।
তিনি বলেন, আমি আমার বাবা হত্যার বিচার চাই। যারা আমাদের বাবাহারা করেছে আমি তাদের বিচার চাই। বাবা না থাকার কারণে আমাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারের প্রতি আহবান জানাবো আমাদের জন্য যেন এটা ব্যবস্থা করে, যাতে আমার লেখাপড়া করতে পারি।
সরেজমিন বংশালের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সারফুউদ্দীনের স্ত্রী তার দুই সন্তান নিয়ে নিচ তলার একটি ছোট কক্ষে বসবাস করছেন। স্বামীহারা সেলিনা তার সন্তানদের লেখাপড়াসহ তার পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানান।
সেলিনা খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামীর মৃত্যুতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা কখনো পূরণ হবার নয়। তবে সরকার যদি আমার সন্তানদের শিক্ষার খরচ বহনসহ আমার পরিবারের দায়িত্ব নেয় তাহলে এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি মিলবে।’
তিনি বলেন, আসলে সেদিনের অবস্থা ও কষ্টের কথা বলা খুবই কঠিন। ছেলে-মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আর কোন পরিবারকে যেন এমন সমস্যায় পড়তে না হয় আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি।
আন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে তিনি জানান, বাচ্চাদের নিরাপদ ভবিষ্যত চাই। ওদের সঠিক ভাবে পড়া লেখা শেখাতে চাই। কিন্তু আমার তো কোন আয় নেই। তাই সরকারের প্রতি আহবান, ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে যাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি যারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন রাষ্ট্রীয় ভাবে সবাইকে শহিদের মর্যাদা দেওয়ার দাবী জানান তিনি।
সারফুউদ্দীনের চাচাতো ভাই নাসির উদ্দিন বলেন, ‘সারফুউদ্দীন খুবই ভালো মানুষ ছিল। ব্যবসা নিয়েই থাকত। নামাজ-কালাম পড়ত। আমাদের বাল্যকাল কেটেছে একসঙ্গে। কত স্মৃতি আছে। চোখ বন্ধ করলে ভেসে ওঠে। ও নিজেই এখন স্মৃতি হয়ে গেছে। ওর কথা মনে হলেই আমার দুই চোখ ভিজে আসে।’
সারফুউদ্দীনের শ্যালক মো. রিপন বলেন, দুলাভাই কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এমনকি বেশি মানুষের ভিড় কিংবা আড্ডা পছন্দ করতেন না। তার এমন মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না। আমার বোন ও ভাগিনা-ভাগ্নির মুখের দিতে তাকাতে পারি না। এই পরিবারকে কে এখন দেখবে ?