বাসস
  ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৫০
আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:৩২

পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে পারিনি কিন্তু জীবন দিয়ে দেশকে ফ্যাসিস্ট মুক্ত করেছেন রাহুল

প্রতিবেদন : এসকে রাসেল

কিশোরগঞ্জ, ৪ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : পরিবারে অভাব অনটন। তাই সচ্ছলতা আনতে ছয় মাস আগে কাজের কাজের সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হন রাহুল। ঢাকায় যান তিনি।

রামপুরা এলাকায় একটি জুতার দোকানে কাজ নেন। দরিদ্র পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে পারেননি। কিন্তু জীবন দিয়ে দেশকে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ মুক্ত করে গেছেন যুবক আয়মান হোসেন রাহুল (২২)।

জানা গেছে, গত ১৮ জুলাই ঢাকার যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন রাহুল। সেখানে ছোঁড়া টিআরশেলের গ্যাসে  অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ফিরে আসেন বাসায়। কর্মস্থলের কাছেই ছিল বাসা। কিন্তু বাসায় তার অবস্থা খারাপ হলে বাড়ি চলে আসেন রাহুল। বাড়িতে তার শারীরিক অবস্থা গুরুতর হলে ২২ জুলাই তাকে বাজিতপুরের ভাগলপুর জহিরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কিছুটা সুস্থ হলে ৭ আগস্ট সকালে রিলিজ নিয়ে বাড়িতে চলে আসেন তিনি। একই দিন বিকালে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাকে আবারো জহিরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান পরিবারের লোকজন।

কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রেফার করেন। গত ৮ আগস্ট বিকেলে ঢাকায় নেওয়ার পথে নরসিংদী সদর এলাকায় তিনি মারা যান। পরে জানাজা শেষে এলাকার সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয় শহিদ রাহুলকে। কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের শহিদদের তালিকায় ৮ নম্বরে নাম রয়েছে আয়মান হোসেন রাহুলের।

আয়মান হোসেন রাহুল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার দিঘীরপাড় ইউনিয়নের পাটুলি বালুর মাঠ এলাকার ট্রলারচালক মো. মিজান (৪৫) ও গৃহিণী রুমা আক্তার (৩৭) দম্পতির বড় সন্তান। রাহুলরা চার ভাই বোন। ছোট ভাই মো. রাতুল (১৭) বাবার সাথে কাজ করে। রুবাইয়া (১৪) মাদ্রাসা দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে ও সবার ছোট্ট বোন ছয় বছর বয়সী সুরাইয়া এখনও পড়াশোনা শুরু করেনি।

সরেজমিনে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার দিঘীরপাড় ইউনিয়নের পাটুলি বালুর মাঠ এলাকায় আয়মান হোসেন রাহুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাবা মো. মিজান ও ছোট ভাই কিশোর রাতুল কাজের জন্য বাড়ির বাইরে। ঘরের সামনে মা ও বৃদ্ধা দাদি লালবানু বসে আছেন। ছোট বোন রুবাইয়া মাদ্রাসায় চলে গেছে ও সবার ছোট্ট বোন সুরাইয়া পাশের বাড়িতে খেলাধুলা করছে। এখনও সুরাইয়া বুঝতে শেখেনি যে তার বড় ভাই রাহুল চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে।

মা রুমা আক্তার বড় সন্তান রাহুলকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন। তিনি বলেন, আমার বাবা রাহুল খুবই ভালো ছিলো। অল্প কিছু লেখাপড়া করেছে। পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে মাস ছয়েক আগে ঢাকায় যায় কাজ করতে। কাজ শুরুর পর  বাড়িতে ঢাকা-পয়সাও পাঠাতো নিয়মিত। ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলনে যোগ দেয় রাহুল। টিয়ার গ্যাসে আমার বাবা অসুস্থ হয়ে বাড়িতে চলে আসে। হাসপাতালে কয়েকদিন থাকার পর বাড়িতে আনা হয়। বাড়িতে আনলে আবারো অবস্থা খারাপ হলে ডাক্তার তাকে ঢাকায় পাঠায়। ঢাকায় নেওয়ার পথে আমার বাবা মারা যায়। ডাক্তাররা বলছিল, আমার বাবার ভিতরে নাকি সব নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আমার বাবাকে আর বাঁচানো গেল না। 

কান্না জড়ানো কন্ঠে তিনি আরো বলেন, ‘এখনো প্রতিদিনই আমার বাবা রাহুলের কথা মনে হয়। যে সন্তান হারিয়েছে সেই বোঝে কষ্টটা আসলে কতো। ট্রাইব্যুনালে আমার বাবা রাহুল হত্যার জন্য মামলা দায়ের করেছি। আমার বাবাকে হত্যা করেছে আমি তাদের ফাঁসি চাই। এখনও সরকারি কোনো অনুদান আমরা পাইনি। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে ১ লাখ ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছি। সরকার যদি আমাদের পাশে দাঁড়ায় তাইলে আমরা বাঁচতে পারবো।’

শহিদ রাহুলের দাদি লালবানু বলেন, ‘এলাকার কেউ আমার নাতিকে খারাপ বলতে পারবে না। কোনদিন কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। আমার নাতি যে কোথায় হারিয়ে গেল। আর তো রাহুল বাড়িতে আসে না। আমার নাতিকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের ফাঁসি চাই।’