শিরোনাম
প্রতিবেদন: সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন
ঢাকা, ৪ জানুয়ারি ২০২৫ (বাসস): বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন মাহাদী হাসান পান্থ। পরিবারে তখন একদিকে শোক, অন্যদিকে চলছিল আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নির্মম নির্যাতনের ভয়াবহতা।
নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী পান্থ গত ১৯ জুলাই শহরের যাত্রাবাড়ির রায়েরবাগ এলাকায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে শহিদ হন। তাদের এই আত্মত্যাগ স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনকে বেগবান করে। এইচএসসি ২০২৪ এর প্রকাশিত ফলাফলে পান্থ জিপিএ ৩.১৭ অর্জন করেন।
মাহাদী হাসান পান্থ’র (১৮) বড় ভাই মেরাজ হোসেন পিয়াল সম্প্রতি যাত্রাবাড়ির দনিয়া এলাকায় তাদের পাটেরবাগের বাসায় বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা যখন আমার ভাইয়ের মরদেহ জানাজার জন্য এখানে নিয়ে আসি, তখন কিছু অজ্ঞাত ব্যক্তি তার মরদেহ এখানে না রাখার জন্য চাপ দেয়।’
উল্লেখ্য, পান্থদের মূল বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায়।
তিনি বলেন, ‘তারা দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় বসবাস করছেন এবং আওয়ামী লীগের সব লোককে চেনেন। সে কারণে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা তাদের চাপ দেওয়ার জন্য অজ্ঞাত ব্যক্তিদের ব্যবহার করেছিল।’
পিয়াল আরো বলেন, ‘এমনকি স্থানীয় মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিনরাও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের কারণে মৃতদেহ বহনের জন্যে খাটিয়া দেয়ার সাহস করতে পারেননি। এক পর্যায়ে প্রতিবেশি এক চাচা মসজিদ থেকে জোর করে লাশ বহনকারী খাটিয়া নিয়ে আসেন।’
তিনি জানান, ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজন মিলে আওয়ামী মাস্তানদের প্রতিহত করে এবং পান্থ’র মরদেহ এক মিনিটের জন্যও সরানো হবে না বলে জানিয়ে দেয়। স্থানীয় জনতার প্রতিরোধের মুখে এক পর্যায়ে মাস্তানরা ঘটনাস্থল থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়।
সোনারগাঁ সরকারি কলেজের তৃতীয় বর্ষের (অনার্স) ছাত্র পিয়াল ফ্যাসিবাদী দমন পীড়নের কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘পান্থ’র মরদেহ দাফন করতেও আমরা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। কারণ আমরা ইসলাম ধর্মের চর্চা করি, তাই আমার ভাইয়ের লাশের ময়না তদন্ত করতে চাইনি।’
পান্থ’র মৃত্যু ও দাফন প্রক্রিয়ার প্রত্যক্ষদর্শী মো. সজিব হোসেন তপু বলেন, তারা মাতুয়াইল, জুরাইন, দনিয়া ও শারোলিয়াসহ আশেপাশের কবরস্থানের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনো ইতিবাচক সাড়া পাননি।
তিনি জানান, কবরস্থান কর্তৃপক্ষ পান্থ’কে দাফনের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। এ ব্যাপারে কথা বলতে গেলে কবরস্থান কর্তৃপক্ষ পুলিশ ক্লিয়ারেন্স এবং ময়না তদন্তের প্রতিবেদন ছাড়া দাফনের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
তপু বলেন, অবশেষে সেখানে উপস্থিত লোকজন প্রথমে নামাজে জানাজা এবং পরে মরদেহ নিকটস্থ কবরস্থানে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
তপু বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমরা লাশটি পাটেরবাগ পারিবারিক কবরস্থানে নিয়ে যাই এবং সেখানে জোর করে দাফন করি। যেহেতু আমরা সংখ্যায় অনেক ছিলাম, কবরস্থান কর্তৃপক্ষ আমাদের থামাতে পারেনি।’
পান্থ’র পরিবারের সদস্যরা জানান, মরদেহ দাফনের পরও তারা আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হয়রানির শিকার হয়েছেন।
পিয়াল বলেন, ‘পান্থ’র দাফনের দুই-তিন দিন পর সাংবাদিকের ছদ্মবেশে ডিবি পুলিশ আমাদের বাড়িতে আসে। বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের পর তারা স্বীকার করে যে তারা সাংবাদিক নন, ডিবি পুলিশ।’
পিয়াল জানান, ডিবি পুলিশ সেদিন বলেছিল, ‘আমরা আপনাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছি। আমরা আপনাদের সম্পর্কে জেনেছি আপনারা ভাল মানুষ। কিন্তু আমাদের কাছে আপনাদের সম্পর্কে অনেক ফাইল এবং নথি আছে, যেখানে আপনাদের নাম আছে। আপনাদের জন্য আমাদের কিছু করার নেই। আমরা আপনাদের সম্পর্কে তদন্ত করতে বাধ্য।’
পিয়াল বলেন, আ.লীগ সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকলে আমাদেরকে আরো অনেক সমস্যায় পড়তে হতো। তাই আমরা যে কোনো মূল্যে ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনার পতন চেয়েছিলাম। স্বৈরাচারী সরকারের পতন কামনা করে আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে প্রতিদিন প্রার্থনা করতাম।
পান্থ’র শোকাহত মা গৃহবধু শাহিনুর বেগম (৪০) বলেন, তিনি তাহাজ্জুদ (যে কোনো ইচ্ছা পূরণ করার জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী বলে বিবেচিত বিশেষ নামাজ) পড়তেন এবং স্বৈরাচারী সরকারের উৎখাতের জন্যে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন।
একজন পরোপকারী, সহানুভূতিশীল এবং দূরদর্শী তরুণের অকাল মৃত্যু
পান্থ একজন পরোপকারী, সহানুভূতিশীল এবং দূরদর্শী যুবক ছিলেন। তার মা শাহিনুর ভারি কন্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে খুবই সহানুভূতিশীল ও পরোপকারী ছিল। সে প্রত্যেক বছর রমজান মাসে গরিব মানুষের মধ্যে ইফতার বিতরণ করত।’
পুত্রের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শাহিনুর। তিনি অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলেন, ‘যখনই, আমি সুস্বাদু খাবার রান্না করতাম, পান্থ বলতো, মা, আপনি এত আইটেম রান্না করেন কেন? আপনি যখন আমাদের জন্য এত সুস্বাদু খাবার রান্না করছেন, তখন ফিলিস্তিনি শিশুরা তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে।’
তিনি জানান, এসএসসি পরীক্ষায় পান্থ জিপিএ ৪.৩৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ায় তাকে পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ব্যক্তিগত কম্পিউটার (পিসি) কিনে দেয়া হয়। কিন্তু তার অপর এক বন্ধুর কম্পিউটার কেনার সামর্থ্য না থাকায় পান্থ সেটি তাকে দিয়ে দেয়।
আমি যখনই অসুস্থ বোধ করতাম, আমার ছেলেটা আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলতো, ‘মা, আমার ছোট্ট পাখি, তোমার কি খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে’?
পান্থ’র মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছেলে সবসময়ই আমার কাছে আদর চাইতো। যখনই সে বাড়ি ফিরতো তখনই তার মাথায় ও পিঠে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেতে হতো। কোনসময় আমি এটা ভুলে গেলে সে আমার ওপর অভিমান করতো।’
তিনি কখনো চাননি যে তার ছেলে আন্দোলনে যোগ দিক। কিন্তু আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের দমন-পীড়নের প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় তখনই তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে পান্থ রাজপথের বিক্ষোভে যোগ দেন।
পান্থ’র ক্রন্দনরত মা বলেন, পান্থ এইচএসসি পরীক্ষার্থী হওয়ায় আমি তার আন্দোলনে যোগ দেয়ার ব্যাপারে নারাজ ছিলাম। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কর্মীদের দ্বারা এক ছাত্রীকে মারধরের ভিডিও দেখে আবেগাপ্লুত পান্থ কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো, ‘মা তাদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে।’ কিন্তু মা ছিলেন অনড়। মাকে রাজি করাতে না পেরে শেষপর্যন্ত পান্থ কোচিংয়ে যাওয়ার নাম করে আন্দোলনে নামেন।
শাহিনুর বেগম তার আদরের পুত্রের সাথে শেষ মূহুর্তের কথোপকথন স্মরণ করে বলেন, ‘পান্থ আমাকে না জানিয়ে চার দিন আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো। শেষ দিন সে বিকেল ৪টার দিকে বাসা থেকে বের হয়। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আমার হাত ও কপালে চুমু খায়। সে আন্দোলন করতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আমি জোরে জোরে কথা বলছিলাম যাতে ঘর থেকে তার বাবা শুনতে পান এবং তাকে আন্দোলনে যাওয়া থেকে বিরত করতে পারেন।’
আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য পান্থ’র দৃঢ় প্রত্যয়ী উচ্চারণ স্মরণ করে তিনি বলেন, পান্থ বলতো, মানুষ অবিচারের শিকার হচ্ছে। চলমান অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব মানুষ একযোগে না দাঁড়ালে এই সংকট থেকে কোনদিন মুক্তি মিলবে না।
ক্রন্দনরত মা পুত্রকে স্মরণ করে জানান, পান্থ বলতো, ‘যদি আমরা সবাই মনে করি যে অন্যরা প্রতিবাদে যোগ দেবে, আমার যাওয়ার দরকার নেই, তাহলে আপনি রাস্তায় কাউকে দেখতে পাবেন না। আর অল্প কিছু লোক যারা সত্যিকার অর্থে রাস্তায় নামবে তাদের ফ্যাসিবাদী সরকারের লোকেরা পিষে ফেলবে।’
তিনি বলেন, বাড়ি ছাড়ার আগে পান্থ তার লম্বা দাড়ি লুকানোর জন্য একটি ক্লিপ চেয়েছিল। বলেছিলো, পুলিশ যদি দাড়ি এবং পাঞ্জাবি দেখে, তারা আমাকে জেএমবি সদস্য মনে করে গ্রেফতার করবে।
জেএমবি বাংলাদেশের একটি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন।
পড়াশোনা শেষ করে পান্থ জাপান যেতে চেয়েছিলো উল্লেখ করে শাহিনুর বেগম বলেন, ‘আমি পান্থকে বলেছি, তোমাকে আন্দোলনে যেতে দিতে চাই না, কারণ তোমাকে গ্রেপ্তার করলে তুমি জাপানে যেতে পারবে না। কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি।’
পান্থ’র মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘পান্থ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে সে আন্দোলনের মাঠ থেকে দূরে থাকবে এবং মাগরিবের নামাজের সময় ফিরে আসবে। কিন্তু সে তার কথা রাখল না।’
পান্থ’র শেষ খাবার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জুম্মার নামাজ থেকে আসার পর পান্থ তার প্রিয় কই মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছিলো। পান্থ কখনই নিজের হাতে খাবার খেতো না। কিন্তু সেদিন আন্দোলনে যাওয়ার জন্য সে এতোটাই উদগ্রীব ছিলো যে, মায়ের হাতে খাওয়ার আবদার না করে, সে নিজের হাতেই ভাত খেয়েছিলো। আমার ছেলে অবশ্য সেদিন তরকারির জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল।’
দুই ভাইয়ের সুসম্পর্কের কথা স্মরণ করে পান্থ’র ভাই পিয়াল বলেন, সারাদেশে ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করার আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মারধরের ভিডিও দেখে পান্থ আহত হয়েছিলো। এরপরই সে আন্দোলনে যোগ দেয় এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে খাবার, বিস্কুট ও পানি বিতরণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
পিয়াল বলেন, ‘আমরা তার নামে বিভিন্ন দোকানে পানি, খাবার এবং বিস্কুট কেনার বকেয়া বিলও পেয়েছি।’
তিনি বলেন, ১৭ জুলাই ছাত্র আন্দোলন যখন ছাত্র-জনতার বিদ্রোহে পরিণত হলো সে সময় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকায় দেশে কী চলছে তা জানতে পান্থ আরও মরিয়া হয়ে ওঠে।
পিয়াল আরো বলেন, ‘সে সময় মিডিয়ার প্রতি আমাদের কোনো আস্থা ছিল না। এই গণজাগরণের সময় হলুদ সাংবাদিকতার অনেক দৃষ্টান্ত আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। যদিও আমরা দেশের বাস্তব চিত্র পাইনি, পরিস্থিতি আমাদের কল্পনার চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল।’
তিনি বলেন, ‘১৮ জুলাই সন্ধ্যায় বন্ধু নাঈমকে গুলি করে হত্যার খবর শুনে পান্থ খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, পরের দিন সন্ধ্যায় (১৯ জুলাই) সে নিজেই গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হয়।’
কাঁদতে কাঁদতে পিয়াল বলেন, সে সময় মা পান্থকে আন্দোলনে যেতে বাধা দিলে সে বলেছিলো, ‘মা, আমাদের সকলের উচিত দেশের চলমান নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নেওয়া।’
রাস্তায় একটি ভয়ঙ্কর দৃশ্য
পান্থ’র ভাইয়ের বন্ধু ও প্রত্যক্ষদর্শী মো. সজিব হোসেন তপু জানান, গত ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে রায়েরবাগে স্বপ্ন সুপার শপের সামনে তারা বিক্ষোভ করছিলেন।
তপু বলেন, ‘পুলিশ যখন নির্বিচারে গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করছিল, তখন আমরা একটি কলাপসিবল গেটের নিচে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিলাম। আমি দেখলাম একজন পুলিশ আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করার জন্য আমার দিকে আঙুল তুলেছে। তাই, আমি সরে গিয়েছিলাম, কিন্তু গুলিটি পান্থ’র মুখে বিঁধেছিল, কারণ সে আমার পেছনে ছিল।’
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অনেক সন্ত্রাসীও রাস্তায় নেমেছিল।
তিনি আরো বলেন, ‘পান্থ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আমি পান্থকে উদ্ধার করতে গেলে আমার পায়েও একটি গুলির সামান্য আঘাত লাগে। পান্থ’র মুখ দেখে আমি আমার বন্ধু পিয়ালকে ফোন করি এবং কিছু তথ্য যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হই লাশটি পান্থ’র।’
তিনি পান্থ’র লাশ নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন দনিয়া উত্তর এলাকার সালমান হাসপাতালে যান এবং পিয়ালকে সেখানেই যেতে বলেন। ওই হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক পান্থকে মৃত ঘোষণা করেন।
পিয়াল বলেন, বন্ধুর ফোন পেয়ে আমি যখন শনির আখড়া যাচ্ছিলাম, তখন রাস্তায় প্রচুর লোকের উপস্থিতি দেখেছিলাম। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট মিটমিট করে জ্বলছিল। সমস্ত পরিবেশ দেখে মনে হয়েছিল, ‘সিনেমা হলে বসে একটি হরর মুভি দেখছি’।
তিনি বলেন, রাস্তায় পুলিশ যখন গুলি চালাচ্ছিলো, লোকজন লক্ষ্যহীনভাবে দৌড়াচ্ছিল, আবার কিছুক্ষণ পরেই এক জায়গায় জড়ো হচ্ছিল। তবে রাস্তায় এতো ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যেও লোকেরা গুলি বা হত্যার ভয় পায়নি।
‘হাসপাতালে পৌঁছে যখন দেখলাম আমার ভাইয়ের মরদেহ একটি বড় জাতীয় পতাকায় ঢাকা, আমি কিছু বলার মতো শব্দ হারিয়ে ফেলি’ হৃদয় বিদারক এ ঘটনার কথা স্মরণ করে পিয়াল কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এরপরেই তপু পান্থ’র বাবা-মাকে হাসপাতালে আসতে বলেন।
শোকাহত পুরো পরিবার
পান্থ’র বাবা কাপড়ের দোকানের মালিক জাহাঙ্গীর হোসেন (৬০) অশ্রু ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলেন, ‘ছেলে শহিদ হওয়ার পর থেকে আমরা শোকাহত। আমরা তাকে এক মিনিটের জন্যও ভুলতে পারছি না।’
তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘পান্থ’র মৃত্যুতে আমরা জীবন্ত লাশে পরিণত হয়েছি। মৃত্যুর পর থেকেই তার মা অসুস্থ। সুস্থ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।’
পিয়াল বলেন, এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাদের আলাদা করতে পারে এটা আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিলো।
পান্থ’র মৃত্যুর পাঁচ মাস পরেও তার উপস্থিতি অনুভব করে বিষণ্ন পিয়াল বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমি আমার সামনে অনেক লোককে মরতে দেখেছি, কিন্তু আমার ভাই যে তাদের মতো লাশ হতে পারে তা আমি কখনই ভাবতে পারিনি।’
‘আমি এখনও ঘুমের মধ্যে তাকে স্বপ্ন দেখি এবং অনুভব করি যে আমার ভাই বেঁচে আছে। আমি আমার পাশের বিছানায় তার অস্তিত্ব অনুভব করি, কিন্তু যখন আমি তাকে স্পর্শ করার জন্য আমার হাত বাড়িয়ে দেই, তখন আমি শূন্যতা অনুভব করি,’ পিয়াল তার হৃদয়বিদারক অনুভূতিগুলি বলার সময় একটি শিশুর মতো কাঁদছিলেন।
পান্থ’র বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার রক্তমাখা শার্ট, বিছানার কভার, যে গামছা দিয়ে তাকে ঢেকে রেখেছিল, যে গামছা দিয়ে তার আহত স্থান বাঁধা ছিল, তার ট্যাবলেট পিসি এবং তার কিছু বই পরিবারের সদস্যরা সংরক্ষণ করে রেখেছেন। পান্থ’র মা তার জিনিসপত্র দেখাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
পান্থ’র ক্রন্দনরত বাবা বলেন, ‘আমার ছেলেকে হত্যা করার পর থেকে আমরা আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে বিচার চাইব না বলে পণ করেছিলাম। সরকার পরিবর্তন হওয়ায় আমরা এখন আন্দোলনের সময় যারা মানুষ হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই যাতে শহিদ পরিবারগুলো তাদের মনে শান্তি পায়।’
গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার জন্য বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।