বাসস
  ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩:৪২

‘ছোট একটা ছেলে, ওরে কিভাবে গুলি করতে পারলো? ওরা না হয় আমারে দুইটা গুলি করতো’- শহিদ আব্দুল্লাহ’র পিতা

প্রতিবেদন: বরুন কুমার দাশ

ঢাকা, ৬ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : পড়ালেখা না শিখিয়ে যদি আমার সাথে ছেলেডারে ব্যবসায় বসিয়ে দিতাম, তাহলে আমি তারে হারাইতাম না। কেন যে আমি ওরে শিক্ষিত বানাইতে গেলাম? ওর মৃত্যুর জন্য আমি দায়ি। শিক্ষিত বানাইতে গিয়ে ওরে আমি নিজ হাতে মেরে ফেললাম।  

কে জানতো ছেলেটা এই অসময়ে চলে যাবে। আমি চেয়েছিলাম ও আমাকে কাঁধে নিয়ে গিয়ে কবর দেবে। কিন্তু এই বুড়ো বয়সে আমি আমার ছেলের লাশ কাঁধে করে কবরস্থানে নিয়ে গেছি। ওকে কবরে নামিয়ে শুইয়ে এসেছি। একজন বাবা হিসাবে এটা আমার জন্য যে কত কষ্টের সেটা আমি বুঝাতে পারবো না। এই বলে কাঁদতে থাকেন আবু বক্কর সিদ্দিকী।  

সম্প্রতি রাজধানীর বংশাল থানাধীন ধোলাইখালের টং মার্কেটের দোকানে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এসব কথা বলেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত ছাত্র আব্দুল্লাহ সিদ্দিকীর বাবা আবু বক্কর সিদ্দিকী। 

তিনি বলেন, ‘আমার অনেক ইচ্ছা ছিল ছেলে-মেয়েরে লেখা পড়া শিখানোর। আমি কষ্ট করে ওদের লেখাপড়া শিখিয়েছি। কিন্তু আমার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে একমাত্র ছেলেরে হারিয়ে ফেললাম। ছেলেডারে মেরে ফেললাম।’

আব্দুল্লাহ’র ছোট বেলার একটা ছবি দেখিয়ে ওর স্মৃতিচারণ করে তার বাবা বলেন, ‘ওর তো সুন্দর ভাবে জীবন কাটানোর কথা ছিল। কেন ছেলেডারে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হল? এই তো কয়েক বছর আগেই ও খেলতো, ঘুরে বেড়াতো। ছেলেটার মায়াবী মুখ ছিল। ও অনেক মেধাবী ছিল। ছোট একটা ছেলে। ওরে কিভাবে গুলি করতে পারলো? ওরা না হয় আমারে দুইটা গুলি করতো।’    

প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু পারি নাই। আমার একটা ইচ্ছা প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করার। আমার ছেলেটা দেশের জন্য জীবন দিল, আর কেউ আমার সাথে দেখাও করলো না। এটা আমার জন্য খুব কষ্টের। আমি প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করতে চাই।’

শহিদ আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী ২০০৩  সালের ১৩ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ২১ বছর। আব্দুল্লাহ হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের ২১-২২ শিক্ষাবর্ষের মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি রায় শাহ বাজার সূত্রাপুর এলাকায় বসবাস করতেন। বাবা আবু বক্কর সিদ্দিকী (৫৯) ও মা আবেদা সুলতানা (৫০)।  সিফা সিদ্দিকী (২৮) ও আফ্রিন সিদ্দিকী সাফা (১১) নামে আব্দুল্লাহ’র দু’বোন রয়েছে। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেলেও ছোট বোন সাফা স্থানীয় একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ালেখা করছে। আব্দুল্লাহ’র মা গৃহিণী। 

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ৪ আগস্ট বিকেল ৪ টার  দিকে রাজধানীর ঝিগাতলায় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী। বুকের ডান পাশে গুলি লাগে আব্দুল্লাহ’র। পরে ৫ আগস্ট যোহরের নামাজের পর রায় শাহ বাজার মসজিদে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়। 

সেদিন আব্দুল্লাহ’র সাথে যারা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের বরাত দিয়ে আবু বক্কর সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি ওই দিন সকালে ওরে কিছু টাকা দিয়ে, দোকানে থাকার কথা বলে সিলেট যাই। পরে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ফোনে খবর পাই, আন্দোলন করতে গিয়ে আব্দুল্লাহ’র পায়ে গুলি লাগছে। এটা শুনে আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন করে ওঠে। তখন ওর বন্ধুকে বলি আব্দুল্লাহকে ফোনটা দিতে। ওই পাশ থেকে বলে সে অজ্ঞান হয়ে গেছে। তখন আমি যা বোঝার বুঝে ফেলি এবং তাড়াতাড়ি ঢাকায় ফিরে আসার চেষ্টা করি।’

বন্ধুদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসক ওকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে আমাকে ওর বন্ধুরা ফোন করে জানতে চায় এখন ওর লাশ কি করবে। আমি ওদের বলি, লাশ বাসায় পৌঁছে দিতে। 

সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে আব্দুল্লাহ সিদ্দিকীর বাবা আবু  বক্কর সিদ্দিকী বলেন, সকল শহিদ ও আহতদের যেন সরকারি কোষাগার থেকে সহযোগিতা করা হয়। শুধু মুখে শহিদ বললেই হবে না, তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে হবে। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যত শহিদ হয়েছেন, তাদের সবার কবরে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানাতে হবে। 

সকল শহিদের পরিচয় পত্র দেওয়ার পাশাপাশি তাদের পিতা ও মাতাকেও পরিচয়পত্র দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, গণভবনে যে জাদুঘর করা হচ্ছে, সেখানে সকল শহিদ ও আহতের ছবি রাখতে হবে। সরকার থেকে বারবার বলা হচ্ছে, প্রত্যেক শহিদের পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা দেওয়া হবে। আমার প্রশ্ন এটা কেন বলা হচ্ছে? একটা জীবনের মূল্য কি ৩০ লাখ টাকা? এটা বলে শহিদদের অপমান করা হচ্ছে।

শহিদ আব্দুল্লার মা আবেদা সুলতানা বলেন, ‘সকালে ছেলে আমার খিঁচুড়ি খেয়েছিল। ওই খাওয়াই যে ওর শেষ খাওয়া হবে তা তো আমি জানতাম না। ৪ আগস্ট সকালে আমি ছেলেকে বলেছিলাম, আন্দোলনে কিন্তু একা যাইসনা, গেলে আমাকে নিয়ে যাইস। আমি বুঝতে পারি নাই, ছেলে আমার শহিদ হবে। আমি এই হত্যার বিচার চাই।’ 

তিনি বলেন, ‘আব্দুল্লাহ একটা বাইক ও ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা কিনতে চেয়েছিল। সেজন্য সে টাকাও কিছু জোগাড় করেছিল। কিন্তু তা আর হলো না। আমার ছেলেডারে গুলি করে মারা হল।  গত ১৩ অক্টোবর ওর জন্মদিন ছিল। এই বছর আর জন্মদিন পালন করা হল না। আমার ছেলে জীবন দিয়ে দ্বিতীয়বার দেশ স্বাধীন করেছে। আমি চাই আমার ছেলে রাষ্ট্রীয়ভাবে যেন শহিদের মর্যাদা পায়।’ 

আব্দুল্লাহ’র ছোট বোন আফ্রিন সিদ্দিকী সাফা বলেন, ‘ওই দিন (৪ আগস্ট) ভাইয়া বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমাকে বলেছিল, খরগোশ গুলোকে খাবার দিতে। আরও বলেছিল, খরগোশের খাওয়ার জন্য ঘাস একটু কম আছে। আমি যেন সেই খাবারগুলো হিসেব করে খরগোশকে খেতে দেই। খরগোশ গুলো আছে, কিন্তু ভাইয়া আর নেই। এই বছর ভাইয়ার জন্মদিন আর পালন করা হল না।’ 

আব্দুল্লাহ’র বান্ধবী নূর নাহার বলেন, ‘আন্দোলনে অংশ নিয়ে আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী ঝিগাতলায় শহিদ হয়েছে। তার বুকের ডানপাশে গুলিটি বিদ্ধ হয়। আব্দুল্লাহ খুব ভালো ছেলে ছিল। সবার সাথে মিশতে পারতো। ওকে খুব মিস করি।’ 
হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আলী বর্দ্দিন বলেন, ‘আব্দুল্লাহ আমাদের সবার জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার আদর্শ ও আত্মত্যাগ আমাদেরকে ন্যায়ের পথে চলতে সবসময় অনুপ্রাণিত করবে। তার আত্মত্যাগ শুধু আমাদের কলেজ নয়, সমগ্র সমাজের জন্য একটি অনুপ্রেরণার উৎস। আব্দুল্লাহ’র মত সাহসী যুবকদের কারণেই সমাজে পরিবর্তন আসে। আমাদের উচিত তার আদর্শকে বুকে ধারণ করে একটি উন্নত, সুশৃঙ্খল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করা।’