বাসস
  ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫৮

সংসারের আর হাল ধরা হলো না শহিদ পারভেজের

প্রতিবেদন : মহসীন কবির

কুমিল্লা, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫, (বাসস) : পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে প্রায় ৩০ বছর আগে এলাকা ছেড়ে সপরিবারে ঢাকায় চলে যান কুমিল্লার মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুর উত্তর ইউনিয়নের আমিননগর গ্রামের সোহরাব হোসেন(৭০)। টুকটাক কাজ  করে সংসার চালাতেন। কিন্তু একপর্যায়ে বার্ধক্যের কারণে কাজকর্ম করা বন্ধ হয়ে যায় তার।

তাই পরিবারের হাল ধরেন স্ত্রী পারভীন বেগম (৫৭)। তিনি সানারপাড়ের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তার উপার্জন দিয়ে পড়াশুনা করেন বড় মেয়ে পাপিয়া (২০) ও ছোট মেয়ে পপি (১৭)। আর একমাত্র ছেলে মো. পারভেজ (২৩) পড়াশুনা করতেন নারায়ণগঞ্জের সিসিএন মডেল কলেজের ডিগ্রি ক্লাসে। অর্থ সংকটে এক সময় তার দুই মেয়েও পড়াশুনার পাশাপাশি পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেন। বোনদের স্বপ্ন ছিলো পড়াশুনা শেষ করে পরিবারের হাল ধরবেন ভাই পারভেজ। তাই নিজেরা ছোট হয়েও বড় ভাইয়ের লেখাপড়ায় অর্থ যোগান দিতেন। তবে তাদের সে স্বপ্ন ভেঙে যায় গত ২৪ জুলাই। সেদিন পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলিতে তাদের ভাইয়ের পুরো শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। 

বড় বোন পাপিয়া জানান, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড ও সানারপাড় এলাকা প্রায় প্রতিদিনই উত্তপ্ত ছিলো। দেশের বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রীয় বাহিনী নির্বিচারে হামলা চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে। এ দৃশ্য দেখে ঘরে বসে থাকতে পারেননি পারভেজ। পরিবারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই প্রতিদিন মিছিলে অংশ নিতেন। 

গত ২৪ জুলাই দুপুরের খাবারের পরই কাউকে না জানিয়ে ভূইগড় এলাকায় মিছিলে যোগ দেন। তখন স্থানীয় এসবি গার্মেমেন্টস এর সামনে পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে পারভেজসহ কমপক্ষে ৭-৮ জন আহত হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় পথচারীরা। সেখানে ব্যাপক রক্তক্ষরণে পারভেজ অজ্ঞান হয়ে যান। চিকিৎসকরা জানান, তার বুক, পিঠ ও কোমরসহ শরীরের বেশিরভাগ অংশেই গুলি লাগে। চিকিৎসার পর তার কিছুটা জ্ঞান ফিরলেও কথা বলতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ২৫ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। একই দিন মধ্যরাতে তার রক্তাক্ত মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসেন তার সহপাঠীরা। 

সম্প্রতি পারভেজের গ্রামের বাড়ি মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুরের আমিননগরে গিয়ে কথা হয় তার বাবা সোহরাব হোসেনের সাথে।

 

তিনি জানান, অর্থের অভাবে প্রায় ত্রিশ বছর আগে এলাকা ছেড়ে ঢাকার সানারপাড়ে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি দিন মজুরের কাজ করে সংসার খরচ চালাতেন। একটা সময় বয়স বেড়ে যাওয়ায় কোনো কাজ করতে পারছিলেন না। স্ত্রী পারভীন ও দুই মেয়ে পোশাক কারখানায় কাজ করে বর্তমানে সংসার খরচ চালাচ্ছে। আর একমাত্র ছেলে পারভেজ লেখাপড়া করতেন বোনদের খরচে। পারভেজের ইচ্ছে ছিলো লেখাপড়া শেষে সংসারের হাল ধরে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাবেন। বাড়ির পুরাতন জীর্নশীর্ণ ঘরটি মেরামত করে বোনদের বিয়ের ব্যবস্থা করবেন। সর্বশেষ তার শহিদ হওয়ার এক মাস আগে বোনদের উপার্জনে ছোট্ট টিনের ঘরটি মেরামতের দেখভাল করতে কয়েকবার বাড়িতে এসেছেন পারভেজ। সেই ঘরের কাজ এখনও চলমান। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের আগেই অনন্তের পথে চলে গেলেন পারভেজ। 

বাবা সোহরাব আরও বলেন,‘পারভেজ সব সময়ই অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। একমাত্র ছেলে হওয়ায় আমরা তাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করতাম। কিন্ত সে প্রতিদিন লুকিয়ে লুকিয়ে মিছিলে যেতো।’

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরো বলেন,‘আমার ছেলের মতো পরিণতি যেন কারো সন্তানের ক্ষেত্রে না ঘটে।’

তিনি জানান, ঘরের মেরামতের কাজ চলায় বর্তমানে এলাকায় রয়েছেন। আর স্ত্রী ও দুই মেয়ে নারায়ণগঞ্জের ভূইগড় এলাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করায় সানারপাড়ের বাসায়ই থাকছেন। 

তিনি আরও জানান, পারভেজের মৃত্যুর পর স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তার পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ২ লাখ টাকার আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন। আর কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী কায়কোবাদের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন উপজেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ। তাছাড়াও কায়কোবাদের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে অনুদান পাচ্ছেন।

টেলিফোনে পারভেজের বড় বোন পাপিয়া জানান, তার ভাই প্রতিদিনই মিছিলে অংশগ্রহণ করতো। সেদিন দুপুরের খাবারের পর দোকানে যাবে বলে বাসা থেকে বের হয়। আছর নামাজের একটু আগে বাসায় খবর পান পুলিশের গুলিতে আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে গিয়ে ছেলের বিভৎস চেহারা দেখে তার মা পারভীন বারবার মূর্ছা যান। চিকিৎসকরাও এক সময় পারভেজের হাল ছেড়ে দেন। শেষ পর্যন্ত একদিন পর তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর ঘটনায় ২৬

জুলাই অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন বাবা সোহরাব হোসেন। তবে সেই মামলা আর আলোর মুখ দেখেনি। 

এ বিষয়ে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার চাই। 

১২ নং উত্তর রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের যুবদলের সভাপতি ও আমিননগর এলাকার বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন বলেন, পারভেজ ছিলো অত্যন্ত ভালো ছেলে। ঢাকায় থাকলেও প্রায় সময় এলাকায় আসতেন। 

তিনি জানান, তার মরদেহ এলাকায় পৌঁছেছে রাত ১০টার পর। পরিবারের ইচ্ছে ছিলো দূরের আত্মীয় স্বজনরা আসলে সকালে জানাজা দেয়া হবে। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও পুলিশের চাপে তাকে গভীর রাতেই দাফন করতে হয়েছে। তিনি দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, পারভেজের কবরে লাগানো জাতীয় পতাকা সকালে এসে খুলে নিয়ে যায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। যা এলাকাবাসীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে।

মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, পারভেজের পরিবার একটি নিঃস্ব পরিবার। তাই তার মৃত্যুর পর সাবেক মন্ত্রী কায়কোবাদের নির্দেশে পরিবারটির পাশে রয়েছে স্থানীয় বিএনপি। তিনি পারভেজ হত্যায় জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন। 

মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবদুর রহমান বলেন,‘শহিদ পরিবারের সাথে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে নতুন কোনো নির্দেশনা আসলে আমরা তা বাস্তবায়ন করবো।’