শিরোনাম
প্রতিবেদন : মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী
সুনামগঞ্জ, ৯ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : সোহাগ মিয়াদিনমজুর বাবার ছেলে। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তৃতীয়। ছোট বেলা থেকেই শান্ত স্বভাবের ছিল সোহাগ (২৩)।
২০১৯ সালে সৌদি আরব যাওয়ার জন্য তাকে তৈরি হতে বলেন বাবা আবুল কালাম। এক দালালের মাধ্যমে তাকে সৌদি আরব পাঠাবেন তিনি। সে লক্ষ্যে ধার দেনা ও সুদে টাকা এনে পাঁচ লাখ টাকা দালালকে দেন সোহাগের বাবা।
স্বপ্নে বিভোর ছিল সোহাগ। বিদেশে যাবে, পরিবারের আর্থিক অনটন ঘুচাবে।
কিন্তু দিন যায়, বছর যায় দালাল তো আর সোহাগকে সৌদি আরব পাঠাচ্ছে না। এদিকে ঋণের বোঝা বাড়ছে। কি করবেন আবুল কালাম? কোন উপায় না পেয়ে ২০২২ সালে স্ত্রী সহ পাঁচ ছেলেকে ঢাকায় কাজের সন্ধানে পাঠান।
বড় ছেলে মো. বিল্লাল মিয়া (২৬), শুভ মিয়া (২০) ও জুবায়ের মিয়া (১৮) নির্মাণ শ্রমিকের কাজে যোগ দেয়। আর মেজ ছেলে সোহাগ মিয়া বাড্ডায় আশা গার্মেন্টস’এ কাজে যোগ দেয়। স্ত্রী রোকেয়া বেগম ও ছোট ছেলে আজিম মিয়া (১৫)ঢাকায় ভাড়া বাসায় নিজেদের গৃহস্থালীর কাজ করত।
আর সোহাগের বাবা আবুল কালাম গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।
আবুল কালামের ছেলেরা রোজগার করে খেয়ে পরে যে টাকা বাঁচাতে পারতো সে টাকা বাবার কাছে পাঠাতো। আরবাবা ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করতেন। এভাবে চলছিল ২০২২ সাল থেকে দিনমজুর আবুল কালামের পরিবার।
তবে গত ৫ আগস্ট পাল্টে যায় পরিবারটির এ চিত্র। কারণ এদিন সোহাগ শেখ হাসিনার পতনের খবর শুনে ঢাকার বাড্ডার বাসা থেকে বেরিয়ে বিজয় মিছিলে যোগ দেন। আর পুলিশের গুলিতে শহিদ হন।
মো. সোহাগ মিয়ার গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালি ইউনিয়নের গোলামীপুরে। সম্প্রতি গোলামীপুর গ্রামে গিয়ে দেখা মেলে শহিদ সোহাগের বাবা আবুল কালামও মা মোছা. রোকেয়া বেগমেরসাথে। তারা তাদের বাড়ির পাশে শহিদ সোহাগের কবরস্থানের পাশে বসেছিলেন। সাংবাদিক আসার খবর শুনে বাড়িতে আসেন আবুল কালাম (৫৭) ও তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৫০) ।
সোহাগের বাবা আবুল কালাম বাসসকে জানান, তিনি একজন খেটে খাওয়া মানুষ। একশতক ভূমির মালিক। এক শতক ভূমিতে কোনভাবেই ঘর তৈরি করা যায় না। তাই প্রতিবেশীর কাছ থেকে আরো এক শতক ভূমি চেয়ে নেন। সেখানে কুঁড়েঘর তৈরি করে পরিবার পরিজনকে নিয়ে বসবাস করছেন।
তিনি জানান, ছেলেরা বড় হওয়ায় কয়েকটি গরু লালন পালন করতেন। মজুরী কাজ করে সংসার মোটামুটিভাবে চলছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে ছেলে সোহাগকে সৌদি আবর পাঠানোর জন্য ৮টি গরু বিক্রি করে এক লাখ ৮০ হাজার এবং ঋণ (সুদে ৪ লাখ টাকা) নিয়ে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার বুরিস্থল গ্রামের মো.আকলুছ মিয়া (দালাল) কে দেন ছেলে সোহাগকে সৌদি আরব পাঠানো জন্য। কিšুত্ম দালাল আকলুছ সোহাগকে সৌদি পাঠায় বলে ঘুরাতে থাকে। তাই কোন উপায় না পেয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে স্ত্রীও ছেলে মেয়েদের ঢাকায় কাজের সন্ধানে পাঠিয়ে দেন।
শহিদ সোহাগের মা মোছা. রোকেয়া বেগম বাসসকে জানান, ছেলেদের রোজগারে সংসার চালিয়ে যে টাকা বাঁচতো সেটা পাঠিয়ে দিতেন গ্রামের বাড়িতে স্বামী আবুল কালামের কাছে। চার লাখ টাকা ঋণের সুদ অনেক হয়ে গেছে। কিছু কিছু করে পরিশোধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তিনি।
রোকেয়া বেগমকান্নাভরা কণ্ঠে বলেন, ‘ঋণ পরিশোধের জন্যই ছেলে মেয়েদের নিয়ে ঢাকায় যাওয়া। কিন্তু ঢাকায় যাওয়াতেই আমার বুকের মানিক সোহাগকে হারিয়েছি।’
যারা তার বুকের মানিককে গুলি করে খুন করেছে সেসব খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন রোকেয়া বেগম।
শহিদ সোহাগের বড় ভাই নির্মাণ শ্রমিক মো. বিল্লাল মিয়া বাসসকে জানান, জুলাইয়ে আন্দোলন শুরু হলে তাদের কাজ (নির্মাণ শ্রমিকের) বন্ধ হয়ে যায়। কাজ বন্ধ থাকায় চার ভাই মাকে ফাঁকি দিয়ে মিছিলে যেতেন। ৩ আগস্ট ও ৪ আগস্টও মাকে ফাঁকি দিয়ে মিছিল যায় তারা। ৫ আগস্ট সকালে বিল্লাল মিছিলে যান এবং ছোট ভাই সোহাগ ও শুভ কে মিছিলে যেতে নিষেধ করেন। তিনি দুপুরে বাসায় ফেরেন। এসময় তাকে ও তার মাকে ফাঁকি দিয়ে শেখ হাসিনার পতনের খবর শুনে বিজয় মিছিলে যান সোহাগ ও তার ছোট ভাই শুভ। দুই ভাই মিছিলে গিয়ে দু’দিকে ছিটকে পড়ে। বিকেল ৪ টার দিকে তাদের মিছিলটি বাড্ডা থানার সামনে গেলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে প্রথমে শুভ পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাসায় চলে আসে। একটু পর ছোট ভাই সোহাগ বাসায় নেই দেখে তার মোবাইলে ফোন দেন তিনি।
বিল্লাল আরো জানান, সোহাগের ফোনে রিং হচ্ছে, কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। আবার ফোন দিলে একজন ফোন রিসিভ করে জানতে চায় আমি কে। তখন বিল্লাল উত্তর দেন আমি সোহাগের বড় ভাই। সোহাগ কোথায় জানতে চাইলে তখন বলা হয় তাকে পুলিশ গুলি করেছে। সঙ্গে সঙ্গে বাসা থেকে বের হয়ে অন্যদের সহযোগিতায় সোহাগকে স্থানীয় ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এরপর তারা শহিদ সোহাগ ও আহত ছোট ভাই শুভকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলায় চলে আসেন। ৬ আগস্ট জামালগঞ্জ হেলিপ্যাডে দুপুরে শহিদ সোহাগের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে গ্রামের বাড়ির পাশে সমাহিত করা হয় তাকে।
বিল্লাল মিয়া বাসসকে আরো জানান, তার বাবা আবুল কালাম খুব কষ্ট করে তাদের লালন পালন করেছেন। তিনি কখনো দিনমজুরি আবার কখনো রিকশা চালিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ চালাতেন। এখন তিনি কোন কাজ করতে পারেন না। তাই তারাই এখন পরিবারের হাল ধরেছে।
বিল্লাল জানান, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া সোহাগের কবর জিয়ারত করে তাদের এক লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন। এরপর জামায়াতের পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় ছাত্ররা দু’দফায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছে। এছাড়াও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন দিয়েছে ৫ লাখ টাকা।
শহিদ সোহাগের প্রতিবেশী আব্দুল হক(৯৭) বাসসকে বলেন, ‘সোহাগ খুব ভাল ছেলে ছিল। ছিল খুবই শান্ত স্বভাবের। তার প্রতি কারো কোন অভিযোগ বা অনুযোগ ছিল না।
আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসিব করুন।’
জামালগঞ্জ উপজেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মো. ওয়ালী উল্লাহ বাসসকে বলেন, ‘গোলামীপুরের আবুল কালামের ছেলে সোহাগ মিয়া ঢাকার বাড্ডায় পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়েছে এবং তার ছোট ভাই শুভ মিয়া আহত হয়েছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির আহ্বায়ক ইমন দোজা আহমদ বাসসকে জানান, তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে দু’দফায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা শহিদ সোহাগের পরিবারকে দেয়া হয়েছে।
জামালগঞ্জ উপজেলা বিএনপি’র সাবেক সহসভাপতি ও গোলামীপুর গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী বাসসকে জানান, শহিদ সোহাগ শান্ত প্রকৃতির ছেলে ছিল। গ্রামের সবাই তাকে স্নেহ করত।
উপজেলা জামায়াতের আমীর হাবিবুর রহমান বাসসকে জানান, শহিদ সোহাগের পরিবারকে জামায়াতের পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বাসসকে জানান, তিনি সুনামগঞ্জে যোগদানের পরপরই শহিদ সোহাগের কবর জিয়ারত করেছেন। তার পরিবারকে সরকারিভাবে একটি ঘর তৈরি করে দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।
জেলা প্রশাসক আরো জানান, শহিদ সোহাগের পরিবার অভিযোগ করেছে, সৌদি আরব পাঠানোর কথা বলে এক দালাল তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। তাকে সৌদিতেও পাঠায়নি এবং টাকাও ফেরত দেয়নি। বিষয়টি আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে জানানো হয়েছে।