বাসস
  ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪:৫১
আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫:২৪

যে বাড়ির উঠোনে বিয়ের বাজনা বাজতো, সেখানেই নিথর দেহে ফিরে এলেন লিজা আক্তার

প্রতিবেদন: আল-আমিন শাহরিয়ার 

ভোলা, ১১ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন ঘিরে ঢাকায় সহিংসতায় ভোলার বিভিন্ন পরিবারের ৪৬ জন শহিদ হয়েছেন। এ তালিকায় আরো শহিদের নাম যুক্ত হতে পারে বলে প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে।

জুলাই-আগস্টের উত্তাল সেই দিনগুলিতে যারা শহিদ হয়েছেন তাদের পরিবারে এখনও চলছে শোকের মাতম। কিছুতেই থামছে না স্বজনহারাদের কান্না আর তাদের আর্তনাদ।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কোটা সংস্কারের দাবিতে চলা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকাতে সহিংসতায় ভোলার যারা নিহত হয়েছেন, এদের মধ্যে পাঁচজন শিক্ষার্থী। বাকিরা সবাই জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছিলেন। কিন্তু সহিংসতায় প্রাণ দিতে হয়েছে তাদের। গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ স্বাভাবিক হলেও কিছুতেই শোক কাটছে না নিহতদের পরিবারের। লিজা আক্তারের পরিবারেও চলছে একই অবস্থা।

লিজা আক্তার ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার সাচড়া ইউনিয়নের ৯নম্বর ওয়ার্ডের সিকদার বাড়ির দিনমজুর মো. জয়নাল সিকদারের (৬০) মেয়ে। ঢাকাতে আন্দোলনকালে গত ১৮ জুলাই দুপুরের পর গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনি। রাজধানী ঢাকার শান্তিনগরে ১২ তলা ভবনের সাত তলার একটি ফ্ল্যাটে গৃহকর্মীর কাজ করতেন লিজা। 

পরিবারের সদস্যরা জানান, সেদিন গোলাগুলির শব্দ শুনে বাসার বেলকনিতে দাঁড়িয়েছিলেন লিজা। এ সময় হঠাৎ করেই তিনি গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় লিজাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ জুলাই তার মৃত্যু হয়। 

সূত্র মতে, অভাব অনটনের সংসারে অনেকটা বাধ্য হয়ে আট বছর আগে ঢাকাতে গৃহকর্মীর কাজে লিজাকে পাঠান মা-বাবা। বিয়ের বয়স হওয়ায় লিজার বিয়ের কথা চলছিল পরিবারের মধ্যে। সে অনুযায়ী তিন মাস পর বাড়ি ফিরবেন এমনটাই কথা ছিল মায়ের সাথে। কিন্তু মায়ের কোলে সেই সন্তান ফিরলো লাশ হয়ে। 

মেয়েকে হারিয়ে লিজার মা ইয়ানুর বেগম এখন পাগল প্রায়। কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছেন না তিনি। যে মেয়ের ধুমধাম করে বিয়ে দেয়ার কথা ছিল বাড়ির উঠোনে।

সেই বাড়ির উঠোনেই ফিরল লিজার নীরব নিথর দেহ।

তথ্য মতে, পরিবারের অভাবের কারণে ১০-১১ বছর বয়সে ঢাকায় চলে যান লিজা আক্তার (১৯)। ঢাকার শান্তিনগর এলাকায় যে বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন সে বাসার মালিক ভালো মনের হওয়ায় বাড়িতে তেমন আসা হতো না লিজার। দুই এক বছর পর পর গ্রামের বাড়িতে আসতেন তিনি। পাঁচ বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে লিজা আক্তার ছিলেন চতুর্থ।

মেয়ের বয়স বেড়ে যাওয়ায় বাবা-মা মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্র দেখা শুরু করেন। মেয়েকে বাড়িতে চলে আসতে বলেছিলেন মা ইয়ানুর বেগম।

মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য ঘরের কাজও করিয়েছেন। 

লিজা মাকে বলেছিলেন, সে একজনের কাছে বিকেল বেলা কুরআন শরীফ পড়া শিখছেন। তার কুরআন শরীফ পড়া শেষ হতে আর দুই-তিন মাস সময় লাগবে। এরপর বাড়িতে চলে আসবেন। কিন্তু  লিজা আক্তার বাড়ি ফিরলেন। তবে লাশ হয়ে।

শহিদ লিজা আক্তারের বড় বোন সালমা বেগম বাসস’কে জানান, পরিবারের অভাবের কারণে ছোট বেলায় লিজাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখানে শান্তিনগরের একটি বাসায় সে গৃহপরিচারিকার কাজ করতো।  পাঁচ বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে লিজা ছিলেন চতুর্থ নম্বরে। ইতোমধ্যে সবার ছোট বোন লিমা আক্তারের বিয়ে হয়েছে। লিজার বিয়ের জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে প্রস্ততিও নেয়া হয়েছিল। ঋণ নিয়ে নতুন করে ঘরের কাজ করানো হয়। পাত্রও দেখছিলেন তারা। কিন্তু লিজা কুরআন শরীফ পড়া শেষ হওয়ার জন্য গ্রামের বাড়িতে আসেননি। 

লিজা মা’কে বলেছিলেন, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে কুরআন শরীফ পড়া শেষ হলে ঢাকা থেকে একেবারে বাড়িতে চলে আসবেন। লিজা অন্যের বাসায় কাজ করলেও ধর্মের প্রতি ছিলো তার অগাধ বিশ্বাস। নামাজ-রোজায় খুব মনোযোগী ছিলেন তিনি। বাসার মালিকও তাকে কখনো ধর্ম পালনে কিছু বলতেন না। তাকে খুব ভালো জানতেন সকলে। 

গত ১৮ জুলাই লিজা আক্তার মহররমের রোজা রেখেছিলেন। বিকেলে শিক্ষিকার কাছে বাসায় কুরআন শরীফ পড়ছিলেন। এ সময় বাইরে গোলাগুলির আওয়াজ পেয়ে ফ্ল্যাটের বারান্দায় উঁকি দিয়ে বাইরে তাকাতেই একটি গুলি এসে তার বুকে লাগে। সাথে সাথে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়েন লিজা আক্তার। 

দ্রুত তাকে কাকরাইলের আরোরা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অস্ত্রোপাচার করে গুলি বের করেন চিকিৎসক। কিন্তু আইসিউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ জুলাই বিকেলে মারা যান তিনি। পরে অ্যাম্বুলেন্সযোগে গ্রামের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিনের সাচড়া’য় এনে পরদিন পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। লিজা আক্তারের চিকিৎসা ও মরদেহ দাফন করা পর্যন্ত সকল খরচ বাসার মালিকই বহন করেছেন। 

লিজা আক্তারের বাবা মো. জয়নাল সিকদার বাসস’কে জানান, মেয়ে মারা যাওয়ার পর সেপ্টেম্বর মাসে স্থানীয় সাচড়া ইউনিয়ন জামায়াত ইসলামী নেতা মাওলানা আব্দুল হাই অনুদান দেয়ার জন্যে ঢাকায় নিয়ে যান। সেখানে একটি সভা করে তাদের হাতে দুই লাখ টাকার চেক তুলে দেন। এরপর ৪ সেপ্টেম্বর পল্টন থানায় তিনি একটি মামলা দায়ের করেন। পরে ঢাকাতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুটা সুস্থ হয়ে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। এখনো তার সেই অসুস্থতা কাটেনি। 

এদিকে লিজার পরিবারের জন্য সবধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন ভোলার জেলা প্রশাসক মোঃ আজাদ জাহান। তিনি বাসস’কে বলেন, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহিদ

কিংবা আহত সকল পরিবারকেই সহযোগিতা ও তাদের আগামী পথচলা নিশ্চিতে সরকার ওয়াদাবদ্ধ।