শিরোনাম
প্রতিবেদন : সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন
ঢাকা, ১২ জানুয়ারি ২০২৫(বাসস) : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে হতবিহ্বল এম এ রাজ্জাক। এ আন্দোলনের তীব্রতার মুখে স্বৈরাচারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটে।
মোঃ আসিফ ইকবাল (২৯) বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে নগরীর মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
নগরীর মিরপুর এলাকার বাসিন্দা এম এ রাজ্জাকের দুই পুত্র-কন্যার মধ্যে আসিফ বড় এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। আসিফের বাবা এম এ রাজ্জাক (৭০) একটি পোশাক কারখানায় মহাব্যবস্থাপক (জিএম) হিসাবে চাকুরি করতেন। তিন বছর আগে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। আসিফ ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে ব্যাচেলর অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) ডিগ্রি শেষ করার পর ২০১৭ সালে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন।
সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর এলাকায় তার পল্লবীর বাসায় বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাজ্জাক বলেন, ‘আমার ছেলে ছিল আমাদের একমাত্র অবলম্বন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে গেছে। আমরা এখন কি করবো? কার কাছে যাবো?’
রাজ্জাকের একমাত্র কন্যার কয়েক বছর আগে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনই আসিফের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। আসিফের অকাল মৃত্যুতে তার বৃদ্ধ বাবা-মা অসহায় হয়ে পড়েছেন।
আসিফের বাবা বলেন, তার ছেলে একজন সহৃদয় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অন্যের যে কোনো বিপদে সাহায্য করতে পছন্দ করতেন। তিনি একজন ক্রীড়া প্রেমীও ছিলেন।
রাজ্জাক বলেন, ‘আসিফ নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্তদান করতো এবং অন্যদের রক্তদানে উৎসাহিত করতো।’
অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে রাজ্জাক বলেন, ‘আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল তার সম্পদ কাজে লাগিয়ে জাতির সেবা করার লক্ষ্যে একজন বিজনেস আইকন হয়ে ওঠা। কিন্তু একটি বুলেট তার সব স্বপ্ন মুছে দিয়েছে।’
আসিফ যেদিন শহিদ হন, সেদিন আন্দোলনে সঙ্গী ছিলেন তার মামাতো ভাই মোঃ রাশিদুল হাসান। রাশিদুল ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের অধীনে সন্ত্রাসবিরোধী সহায়তা প্রকল্পে দোভাষী দলের প্রধান এবং প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী হিসাবে কাজ করছেন। তারা দুজনেই খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং অবসর সময় একসাথে কাটাতেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রাশেদুল বলেন, ১৯ জুলাই (শুক্রবার) তারা শেখপাড়া এলাকার বায়তুল দারার মসজিদে একসঙ্গে জুমার নামাজ আদায় শেষে মসজিদের সামনের ঈদগাহ মাঠে আধা ঘণ্টা সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর তারা বের হয়ে মিরপুর-১০ নম্বর মোড়ের দিকে যাচ্ছিলেন। আসিফ তখন পানি খেতে চায়।
রাশিদুল বলেন, ‘তাই, আমরা আদর্শ স্কুলের কাছে স্বপ্ন সুপার শপ থেকে বিস্কুট কিনতে যাই এবং স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিক্রেতার কাছ থেকে আখের রস পান করি। আখের রস খেয়ে আমরা মিরপুর-১০ এর মোড়ের দিকে রওনা দেই। এ সময়ে সেখানে আন্দোলনকারীদের সাথে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। সে সময় পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি খুব কম ছিলো।’
তিনি বলেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের তুলনায় সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল বেশি।
আসিফের অসাধারণ নেতৃত্ব গুণের কথা উল্লেখ করে রাশিদুল বলেন, ‘আসিফ এক পর্যায়ে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন এবং আমরা একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলি। আমাদের প্রতিরোধের মুখে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মিরপুর ১০ নম্বরের মেট্রো স্টেশনের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।’
তিনি জানান, জনতার ধাওয়া খেয়ে আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মিরপুর-৬ এর পাশে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে অবস্থান নেয়। পরে পুলিশ রাবার বুলেট ছুঁড়তে শুরু করলে আওয়ামী লীগ কর্মীরা বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।
আসিফের মামাতো ভাই বলেন, ‘আমরা তাদের ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আমরা পেছন থেকে গুলির শব্দ শুনতে পাই। আমরা কাজীপাড়া থেকে ২০-২২টি মোটরসাইকেলের একটি দল নিয়ে আ.লীগের লোকজনকে গুলি ছুঁড়তে দেখি। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তারা মিরপুর-১৩-এ চলে যায়।’
একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শেওড়াপাড়া এলাকার কাউন্সিলর হুমায়ুন রশিদ জনি মোটর শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেন এবং এ ঘটনায় অন্তত তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়।
রাশেদুল জানান, তারা দুপুরের খাবার খেতে বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও রাশেদকে বাসায় পাঠিয়ে আসিফ ঘটনাস্থলেই থেকে যান। এ সময় আসিফের সাথে তার স্কুলের বড় ভাই আরিফ ছিলেন।
আরিফ জানান, মিরপুর-১০ নম্বর মোড়ে শাহ আলী মার্কেটের বিপরীত পাশে তারা বিক্ষোভ করছিলেন। সে সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের লোকজন নির্বিচারে গুলি চালালে তারা একটি গলিতে আত্মগোপন করেন। কিন্তু নিরাপদ জায়গায় যেতে না পারায় আসিফ ফুটপাথের দোকানের পাশে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করছিলেন।
আরিফ বলেন, ‘এর পরপরই, আমরা সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটের দিকে গুলির শব্দ শুনি এবং আসিফকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখতে পাই’। সাথে সাথেই আসিফকে নিকটবর্তী আল হেলাল হাসপাতালে নিয়ে গেলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রেফার করে।
আসিফের মামাতো ভাই রাশিদুল জানান, ওই সময়েই তিনি একটি ফোন পান এবং জানতে পারেন যে আসিফকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমি হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই আরেকটি কল পাই, যার মাধ্যমে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে আমার ভাই আর নেই!’
রাশিদুল জানান, ৭.৬২ মিলিমিটার বুলেটের আঘাতে হার্টের ডান পাশের প্রধান ধমনী ছিঁড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আসিফের মৃত্যু হয়।
আসিফের বুকে বিদ্ধ হওয়া বুলেট সম্পর্কে একজন গোলাবারুদ বিশেষজ্ঞের ব্যাখ্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি একটি দক্ষ স্নাইপারের কাজ ছিলো। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে কমপক্ষে ৩০০-৪০০ মিটার দূর থেকে গুলি চালানো হয়েছিল।’
আসিফের নেতৃত্বের গুণাগুণ সম্পর্কে রাশিদুল বলেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলনেও আসিফ দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করেন। তিনি এই প্রতিবেদককে একটি ছবি দেখান যেখানে আসিফ একটি হ্যান্ড মাইক নিয়ে মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং শত শত ছাত্র তার পেছনে মিছিল করছে।
আসিফকে ২০ জুলাই মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
পল্লবী আবাসিক এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয়রা আসিফের নামানুসারে একটি তিন রাস্তার মোড়কে নামকরণ করেছে ‘শহীদ আসিফ চত্বর’ এবং বিভিন্ন দেয়ালের গ্রাফিতিতে তার ভূমিকা বর্ণনা করা হয়েছে।
আসিফ হত্যার বিচারের বিষয়ে তার বাবা রাজ্জাক জানান, তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৭৩ জনের নামে এবং আরো ৫০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) মামলা করেছেন।
আসিফের হতভাগ্য পিতা রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা আমাদের ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে পারবো না। এখন আমরা শুধু বিচার চাই। আমরা প্রকৃত অপরাধীদের ফাঁসি চাই’।