বাসস
  ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬

গুলির আঘাতে নিশ্চিহ্ন হলো পরিবারের একমাত্র ভরসার কূল

প্রতিবেদন: জাকির হোসেন কবির

পঞ্চগড়, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): গত বছরের ১৯ জুলাই, দিনটি ছিল শুক্রবার। জুম্মার নামাজ শেষ করে আবু সায়েদ(৪৫)ঢাকার মোহাম্মদপুরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে অংশ নেন। এ সময়ে পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। গুলিতে অনেকে হতাহত হন। একটি গুলি এসে আবু সায়েদের মাথার পেছন দিকে লাগে।

ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। 

আবু সায়েদের স্ত্রী আছিয়া বেগম তার স্বামীকে ফোন করছিলেন। কিন্তু  পাচ্ছিলেন না। পরে ফোন ধরেন দেলওয়ার হোসেন নামের একজন। তিনি আবু সায়েদের স্ত্রীকে জানান, তার স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। তখন আনুমানিক সময় বিকেল ৩টা হবে। 

পরিবারের সদস্যরা মোহাম্মদপুর তিন রাস্তায় পৌঁছে দেখেন আবু সায়েদের নিথর দেহ রাস্তার পাশে পড়ে আছে। চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ মেলেনি তার। পরদিন ২০ আগস্ট আবু সায়েদের মরদেহ নিজ বাড়ি পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের নতুন বস্তি গ্রামে আনা হয়। পরে বাড়ির পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

আবু সায়েদের পিতার নাম আবদুল খালেক এবং মা সোনাবান।  

এদিকে আবু সায়েদের স্ত্রী আছিয়া বেগম চাচ্ছিলেন না তার স্বামী মিছিলে যাক। তিনি চেষ্টা করতেন স্বামীকে ঠেকাতে। স্বামীকে  মিছিলে যেতে নিষেধ করে বলেছিলেন, ‘তুমি কেন মিছিলে যাচ্ছো? তোমার ভয় করে না? 

জবাবে আবু সায়েদ বলেছিলেন, ‘সবাই ঘরে বসে থাকলে  আন্দোলন করবে কে? এটা দেশের জন্য আন্দোলন। আমাকে যেতে হবে।’

আছিয়া বেগম বাসসের এ প্রতিবেদকের কাছে ফোনে কথাগুলো বলছিলেন আর কাঁদছিলেন। 

আবু সায়েদ ঢাকার মোহাম্মদপুরে জাপান গার্ডেন সিটির কাছে  পান সুপারীর ব্যবসা করতেন।  ব্যবসা থেকে সময় বের করে নিয়ে অতিরিক্ত সময়ে রিকশা চালাতেন। এই দুই উর্পাজনে মোটামুটিভাবে সংসার চালিয়ে নিচ্ছিলেন। দোকানের পেছনে ভাড়া জায়গায় দ্বিতীয় স্ত্রী ও সাত মাসের একটি পুত্র সন্তান সহ বসবাস করতেন। পঞ্চগড়ের নিজ বাড়িতে প্রথম স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। 

সম্প্রতি কথা হয় প্রথম স্ত্রী মাজেদা বেগমের সাথে। তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে  জানান, ভিটে মাটি ছাড়া তাদের আর কোন স্থাবর সম্পত্তি নেই। স্বৈরশাসক মুক্ত দেশ পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে তার স্বামী আন্দোলনে যোগ দিয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছে। স্বামীর এ আত্মত্যাগে মাজেদা বেগমকে খানিকটা প্রশান্তি দিলেও  দুই সন্তান নিয়ে কিভাবে তাদের জীবন চলবে এ চিন্তার কোন ভাল উত্তর তার জানা নেই। এদিকে বিভিন্ন ভাবে তারা কিছুটা অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়েছেন। তবে তা দুই পরিবারের মাঝে ভাগ হয়ে যাওয়ায় তাতে কোন পক্ষই সুফল পায়নি। তাই জীবন তাদের দুর্বিষহ। শহিদ আবু সায়েদের দুই স্ত্রী মাজেদা বেগম ও আছিয়া বেগম পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা পাওয়ার আশায় রয়েছেন। 

আবু সায়েদ শহিদ হওয়ার পর ছোট স্ত্রী আছিয়া পঞ্চগড়ে স্বামীর বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন। কিন্তু বড় স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওযায় টাঙ্গাইলে ভাইয়ের বাড়িতে আছেন তিনি।

ফোনে কথা বললে আছিয়া জানান, ভাইয়ের সাংসারিক অবস্থাও ভাল না। অনেকটা জোর করে আছেন তিনি। স্বামী অবলম্বন ছিল। কষ্ট করে সংসার চালাতো। ছোট বাচ্চা নিয়ে কি করবেন ভেবে কিছু পাচ্ছেন না। ভাইয়ের সংসারে থাকা যে কষ্টকর সেটা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। 

আবু সায়েদের প্রথম পক্ষের ছেলে মামুন বলেন, ‘আমার বাবা  অভাবের সংসারের হাল ধরতে ঢাকায় গেছেন ব্যবসা করতে। আন্দোলন শুরু হলে তিনি আর বসে থাকেননি।

তাতে যোগ দেন। কিন্তু গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। একটি গুলি আমাদের সব শেষ করে দিলো।  আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। 

মামুনের প্রত্যাশা, দ্বিতীয়বার দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে অনেকে জীবন উৎসর্গ করেছেন। সরকার সবার অবদানের স্বীকৃতি হয়তো দেবে, এ স্বীকৃতিতে তার বাবার জীবন উৎসর্গের বিষয়টি যেন বাদ না পড়ে। 

কারণ এ  ত্যাগই যে হবে মামুনের জীবনের মূল অনুপ্রেরণা।