শিরোনাম
প্রতিবেদন: বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ১৪ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): দিনটি ছিল গেল বছরের ২৪ জুলাই। তখন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল সারাদেশ। বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজের ছাত্র মেহেদী হাসান নাঈম। ওইদিন দুপুর ৩ টার দিকে রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকার রায়েরবাগ মোড়ে পুলিশের সাথে ছাত্র-জনতার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে সিএনজির নিচে চাপা পড়েন তিনি। এতে নাঈম মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান। পরে ৩১ জুলাই রাত ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার মৃত্যুর সঙ্গে তছনছ হয়ে পড়ে একটি পরিবার।
মেহেদী হাসান নাঈম (২২) নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজের মানবিক শাখার ডিগ্রী-৩য় বর্ষ ও ২০১৯-২০ সেশনের ছাত্র ছিলেন। তার রোল নম্বর ২৫৯, রেজি:- ১৯১০১২১৬৯০১।
নাঈমের বাড়ি শরিয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার আইয়ুব বেপারীকান্দি গ্রামে। তিনি পরিবারসহ রাজধানীর মাতুয়াইল দক্ষিণ পাড়ায় ভাড়া থাকতেন। নাঈম ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম আছিয়া খাতুন (১৯)। নাঈমের মরিয়ম জাহান নামে ১১ মাস বয়সের একটি কন্যা সন্তানও রয়েছে।
তার বাবা ফারুক গাজী (৫২) এবং মা নাছিমা বেগম (৪৬)। বাবা মৌসুমি ব্যবসায়ী। মা গৃহিণী। তাসনিমা বেগম (১৮) এবং তানজিলা (১০) নামে নাঈমের দুই বোন রয়েছে। তাসনিমার সম্প্রতি বিয়ে হলেও তানজিলা স্থানীয় একটি মাদ্রসায় পড়ালেখা করছেন। ৩১ জুলাই রাতে নাঈম মারা যাওয়ার পর তাকে ১ আগস্ট শরিয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার আইয়ুব বেপারীকান্দি গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়।
শহিদ নাঈমের বাবা গভীর দুঃখ প্রকাশ করে জানান, সাড়ে পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো কোনো সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য তাদের কাছে পৌঁছায়নি। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে কেউ তাদের খোঁজও নিতে আসেনি।
সম্প্রতি রাজধানীর মাতুয়াইল দক্ষিণপাড়ার বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে নাঈমের বাবা এসব কথা জানান।
এদিকে স্বামী মেহেদী হাসানকে হারিয়ে অকুলপাথারে পড়েছেন হতভাগ্য নববধূ আছিয়া খাতুন। ১১ মাসের কন্যা সন্তানকে নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। কীভাবে জোগাড় হবে সন্তানের খাওয়া-পরার খরচ? কীভাবে বড় করবেন আদরের সন্তান মরিয়মকে?
আছিয়া খাতুন বলেন, ‘আমার এই মেয়ে পাঁচমাস বয়সে তার বাবাকে হারিয়েছে। সে কখনই দেখবে না তার প্রিয় বাবার মুখ। হয়তো কষ্ট, যন্ত্রণা, অবহেলা আর অনাদরে বড় হতে হবে আমার মেয়েটাকে। পরিচর্যা আর অভাবের যাঁতাকলে দুধ কিম্বা পুষ্টিকর খাবারও জুটবে না মেয়েটার। তাছাড়া ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ট বাবাহারা এতিম সহায় সম্বলহীন মরিয়মের দায়িত্ব-ই বা কে নেবেন?’
তিনি বলেন, প্রায় দুই বছর আগে পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়ে হয়েছিলো। মাতুয়াইলে আমি, আমার স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি ও দুই ননদ থাকতাম। স্বামী পড়ালেখা করতেন। আশা ছিল পড়ালেখা শেষ হলে একটা চাকুরি করবে। কিন্তু তা আর হলো না।’
এই বলে সে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। এ সময়ে ১১ মাস বয়সী মেয়েটা মায়ের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মরিয়মের তাকানো দেখেই বোঝা যায় তার কি যেন হারিয়ে গেছে!
এ সময়ে মরিয়মের দাদি (শহিদ মেহেদীর মা নাছিমা বেগম) বলেন, ‘মেয়েটা (নাতিন) সব সময় ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে আব্বু আব্বু বলতে থাকে। তখন যে বুকের মধ্যে আমার কেমন লাগে, এটা বুঝাতে পারবো না। এই ছোট্ট শিশু ওকে কি করে বোঝাই যে ওর আব্বু আর নেই। আর কোন দিন ওরে আদর করে কোলে নেবে না। মেয়েটা ওর আব্বুকে আর দেখতে পাবে না।’
সেইদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে নাঈমের বাবা ফারুক গাজী বলেন, নাঈম শুরু থেকেই প্রতিদিন কোটা আন্দোলনে যোগ দিত। আমার ছেলে কোটা আন্দোলন করতে গিয়ে ২৪ জুলাই রাজধানীর রায়েরবাগে দুপুর ৩টার দিকে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে সিএনজির নিচে চাপা পড়ে। এতে তার মাথা থেঁতলে যায়। সাড়ে ৩ টার দিকে খবর পাই। আমি তখন বাসায় ছিলাম। খবর শুনে দৌড়ে রায়েরবাগ ওভার ব্রিজের নিচে যাই। গিয়ে শুনি ছাত্ররা তাকে শনিরআখড়ার রয়েল হসপিটালে নিয়ে গেছে। পরে আমি রয়েল হাসপাতালে যাই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নাঈমের চিকিৎসা করে না। এদিকে মাথার ক্ষত স্থান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
তিনি বলেন, ‘পরে আমরা সেখান থেকে নাঈমকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে সন্ধ্যা ৬ টার সময় ভর্তি করি। তখন ঢাকা মেডিকেলের কিছু লোক আমাদের বলে, আন্দোলন করতে গিয়ে আহত হয়েছে এই কথা বলা যাবে না, তাহলে চিকিৎসা পাবেন না। বলবেন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ভর্তির পরে অপারেশন করা হয় সন্ধ্যা ৭ টার সময়। তারপর দিন ২৫ তারিখ বৃহস্পতিবার ডাক্তার বলে তাকে আইসিইউ-তে রাখতে হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউর বেড খালি নাই। তখন নাঈমকে মোহাম্মদপুর-১৯ নাম্বার ধানমন্ডি সুপার হাসপাতালে আইসিইউতে নিয়ে যাই। সেখানে অনেক টাকার ঔষধ কিনতে হয়। কিন্তু চিকিৎসা ভালো হচ্ছিল না। পরে ওখান থেকে নাঈমকে ২৬ তারিখ ৩ টার সময় আবার ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। তখন তাকে ইমারর্জেন্সি বিভাগের আইসিইউ-তে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ৩১ জুলাই রাত ১০ টার দিকে নাঈম মারা যায়।’
ফারুক গাজী বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই প্রতিদিন তাতে অংশ নিতো। অনেকবার নিষেধ করেছি। কিন্তু আমার কথা শোনে নাই। আমিও সব সময় বাসায় থাকি না। সে কখন কোথায় যায় তার খবরও রাখা হয়নি। ঘটনার দিন সকালে বাসা থেকে বের হয়েছে। ওর মৃত্যু হয়তো আল্লাহ এই ভাবে লিখে রেখেছিলেন, তা না হলে আন্দোলনে যাবে কেন?
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার বরাত দিয়ে নাঈমের বাবা বলেন, ২৪ জুলাই রায়েরবাগসহ আশে পাশের এলাকায় সকাল থেকে কম বেশি ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। দুপুরের দিকে আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশের তীব্র সংঘাত চলতে থাকে। আন্দোলনকারীরা ইট, পাটকেল ছোঁড়ে। পুলিশের পক্ষ থেকে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়। তখন ছাত্র-জনতা এদিক সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে। এই সময়ে নাঈম পেছন দিকে দৌড়াতে গিয়ে আছড়ে পড়ে। সে সময় অপরদিক থেকে আসা সিএনজির চাকা ওর মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়।
কোন মামলা হয়েছে কি না জানতে চাইলে ফারুক গাজী বলেন, কার বিরুদ্ধে মামলা করবো? যা যাওয়ার তা তো আমার গেছে। মামলা করলেই তো আর নাঈম ফিরবে না। আমি গরীব মানুষ, মামলা চালাতে আবার টাকা পয়সা লাগবে। আমি টাকা পাবো কোথায়?
সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে জানতে চাইলে শহিদ নাঈমের মা নাছিমা বেগম বলেন, আশা ছিল ছেলেটা পড়া লেখা শিখে চাকুরি করবে। আমাদের অভাব দূর হবে। এখন ছেলেই নাই কার কাছে কি আশা করবো। ছেলে শহিদ হওয়ার প্রায় ৬ মাস হতে চললো, কেউ আমাদের একবার খোঁজ-খবর নিল না। সাহায্য সহযোগিতা তো দূরের কথা। তাই কার কাছে কি আশা করবো। শুধু আল্লাহর কাছে চাই, ‘ হে আল্লাহ তুমি নাঈমের স্ত্রী ও মেয়েকে দেখে রেখো’।
তিনি বলেন, ‘তারপরও আমাদের আশা, আমরা কয়দিন আছি। ছেলের বউ ও নাতিনটার যদি একটা গতি হতো। ওদের জীবন কেবল শুরু। ওদের ভালোভাবে বাঁচার জন্য কেউ যদি আমাদের পরিবারের দিকে তাকাতো তাহলে আমরা একটু চিন্তা মুক্ত হতাম। নাঈমের বাবাও অসুস্থ। ডায়াবেটিস আছে। প্রতিদিন তিন বেলা ইনস্যুলিন নিতে হয়। আমরা বড়ো অসহায়, বাবা।’ এ কথা বলে তিনি অঝোরে কাঁদতে থাকেন।