বাসস
  ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৩৮

অসহায় জীবন আন্দোলনে যোগ দেয়া আহত মুুরাদের

প্রতিবেদন: মহিউদ্দিন সুমন

টাঙ্গাইল, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : মুরাদ হোসেনের শরীরে এখনো রয়েছে অসংখ্য ছররা গুলি। শরীরে দু’শোরও বেশি ছররা গুলি নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন তিনি। কাতরাচ্ছেন অসহনীয় ব্যথায়। এদিকে চলতি বছরে তার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ শরীর নিয়ে তিনি আর পরীক্ষা দিতে পারছেন না।   

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন মুরাদ হোসেন (১৮)। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের দিন ঢাকার আশুলিয়া থানার সামনে ছাত্র জনতার বিজয় মিছিলে অংশ নেন তিনি। এ সময়ে মারমুখী পুলিশের ছোঁড়া ছররা গুলি তার সারা শরীরে বিদ্ধ হয়। বিশেষ করে তার দু’টি পা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতোমধ্যে চার দফা অপারেশন করে ২১টি গুলি বের করা হয়েছে। বর্তমানে আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসা করাতে পারছেন না মুরাদ। নিজ বাড়িতেই অসহায় অবস্থায় জীবনযাপন করছেন তিনি।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার পাইস্কা ইউনিয়নের কয়রা পূর্ব পাড়ায় মুরাদের গ্রামের বাড়ি। এ গ্রামের মফিজুল হক ও মনোয়ারা বেগম দম্পত্তির তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে মুরাদ সবার ছোট। বাবা পেশায় একজন কৃষক। মা মনোয়ারা বেগম গার্মেন্টস কর্মী। এ সুবাদে ঢাকার আশুলিয়া এলাকায় সাভার কনফিডেন্স মডেল স্কুলে দশম শ্রেণিতে লেখাপড়া করতেন মুরাদ হোসেন।

গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকার পতনের আনন্দ মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ একযোগে টিয়ার শেল ও ছররা গুলি ছোঁড়ে। এ সময় মুরাদের সারা শরীরে অসংখ্য ছররা গুলি লাগে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা শেষ করে বর্তমানে বাড়িতে থেকে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট সিএমএইচএ চিকিৎসা নিচ্ছেন মুরাদ।   

সম্প্রতি সরেজমিনে মুরাদের বাড়ি গিয়ে কথা হয় তার পরিবারের সঙ্গে। মুরাদের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘দুই ছেলেকে নিয়ে আমি প্রায় দীর্ঘ ১৪ বছর যাবৎ আশুলিয়া-বাইপাইল শিমুল পাড়া এলাকায় বসবাস করতাম। আমার বড় ছেলে মোশারক হোসেন এবং আমি একটি গার্মেন্টসে চাকুরি করতাম। আর ছোট ছেলে মুরাদ হোসেন সাভার কনফিডেন্স মডেল স্কুলে লেখাপড়া করতো। মা-ছেলে মিলে চাকুরি করে আমরা যে অর্থ উপার্জন করতাম তা দিয়ে ছোট ছেলের লেখাপড়া ও সংসারের খরচ আমাদের মিটে যেত। কিন্তু গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার মিছিলে আমার ছেলে মুরাদ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে আমাদের জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার।’

তিনি আরো বলেন, ‘সে সময় গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমরা চাকুরি হারিয়ে বেকার হয়েছি। তারপর ঢাকায় ছেলের চিকিৎসা শেষ করে সবাই বাড়িতে ফিরে এসেছি।

মুরাদকে তো আমরা প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলাম। তবে আল্লাহর অশেষ রহমতে ছেলে গুলিবিদ্ধ হলেও বেঁচে তো আছে। এ জন্য আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া।’

মনোয়ারা বেগম বলেন, গণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময়ের চূড়ান্ত দিন ৫ আগস্ট দুই শতাধিকের বেশি ছররা গুলি লাগে মুরাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে। তারপর তাকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। অপারেশন করা হয় তার শরীরে। সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার পর বাড়িতে নিয়ে আসি। এখনো রাতে ব্যথায় কাতরাতে থাকে মুরাদ। ঠিকমত ঘুমাতে পারে না। প্রথম দিকে সরকারি ভাবে ছেলের চিকিৎসার খরচ চললেও এখন আর পাচ্ছি না। বড় ছেলেটাও বেকার।
এ অবস্থায় সংসারের খরচের টাকা জোগাড় এবং ছেলের চিকিৎসা ও ঔষধপত্রের খরচ মেটাতে গিয়ে চোখে মুখে যেন অন্ধকার দেখছেন মনোয়ারা বেগম।

বিএনপির কেন্দ্রীয় জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও স্থানীয় বিএনপি নেতা ফকির মাহবুব আনাম স্বপন (স্বপন ফকির) ২৫ হাজার টাকা এবং উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা অনুদান ছাড়া আর কোন আর্থিক সহযোগিতা পাননি বলে জানান তিনি।

আহত শিক্ষার্থী মুরাদ হোসেন বলেন, আমার শরীরে সবচেয়ে বেশি গুলি লেগেছে দুুই পায়ে। এ জন্য হাঁটা চলা করতে খুব কষ্ট হয়। ব্যথায় রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারি না।

ডাক্তারের কথা উদ্ধৃত করে তিনি জানান, শরীরের ভেতর যে ছররা গুলি রয়েছে তা একবারে অপারেশনের মাধ্যমে বের করা সম্ভব না। এতে করে দুটি পা ক্ষতি হওয়ার আশংঙ্কা রয়েছে। এ জন্য যে গুলি গুলো ভেতর থেকে উপরে ভেসে উঠে সেগুলো অপারেশনের মাধ্যমে বের করা হচ্ছে। এ জন্য চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে গেছে।

কিন্তু তার পরিবার সেই চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারছে না।

মুরাদ বলেন, আমি ছোট বেলা থেকেই অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করে আসছি। এ বছর আমার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আর দিতে পারছি না। এ কথা মনে হলে আমি দু’চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না।

মুরাদের এখন একটাই চাওয়া, সরকার যেন সময় মতো তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয়। আর দ্রুত সময়ের মধ্যে সুস্থ হয়ে আবারও শিক্ষা জীবনে ফিরে আসতে চায় মুরাদ হোসেন।

মুরাদের বড় ভাই মোশারফ হোসেন বলেন, সংসারের অভাব অনটনের কারণে আমাকে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে হয়। এ জন্য আমি খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারিনি। তবে স্বপ্ন ছিল ছোট ভাই মুরাদকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করবো। লেখাপড়া শেষ করে এক সময় ভাল একটা চাকুরি করবে সে। সংসারের অভাব অনটন দূর হবে। কিন্তু এসএসসি পাস করার আগেই আমাদের সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। কবে সুস্থ হয়ে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে আল্লাহতালা ভাল জানেন। আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছি মুরাদকে চিকিৎসা করাতে। আন্দোলনের সময় গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার চাকুরি চলে যায়। আমি বর্তমানে বেকার থাকার কারণে বড় ভাই হিসেবে কোন সহযোগিতা করতে পারছি না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসার জন্য যে বরাদ্ধ ঘোষণা করেছে সেটা যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা পাই, তা হলে আমার ভাইয়ের সুচিকিৎসা করাতে পারবো।

এ বিষয়ে ধনবাড়ী উপজেলার নির্বাহী অফিসার মোঃ আবু সাঈদ বলেন, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ধনবাড়ি উপজেলার দুই জন নিহত এবং সাত জন আহত হয়েছে।

আমরা প্রত্যেককে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছি। তবে নতুন করে বরাদ্দ পেলে সরকারের পক্ষ থেকে মুরাদকে আবারও সহযোগিতা করা হবে।’