শিরোনাম
প্রতিবেদন : মাসুদ রানা
জয়পুরহাট, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : জয়পুরহাট শহরের প্রফেসরপাড়া এলাকার দরিদ্র হোটেল শ্রমিক মোকলেছুর রহমানের একমাত্র ছেলে আকিবুল হাসান রকি। আন্দোলনের সময় তার শরীরে ৬০ থেকে ৬৫ টি ছররা গুলি বিদ্ধ হয়। এখনও রয়ে গেছে ২০ থেকে ২৫ টি। চোখেও কয়েকটা ছররা গুলি লাগে। অপারেশন করে সেসব বের করেন চিকিৎসকেরা। তবে এখনও তার চোখে একটি ছররা গুলি রয়ে গেছে।
রকি এক চোখে দেখতে পান অন্য চোখে পান না।
ডাক্তার বলেছেন, চোখের উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে গুলি বের করতে না পারলে চিরদিনের মত নষ্ট হয়ে যাবে তার ডান চোখ। বর্তমানে রকি শংকায় দিন কাটাচ্ছেন। যদি উন্নত চিকিৎসার সুযোগ পান, তাহলে হয়তো তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন।
রকি আগে চাকরি করতেন একটি টেক্সটাইল কোম্পানিতে। চোখের সমস্যার কারণে চাকরিও চলে যায় তার। বর্তমানে বাড়িতে স্ত্রী নূপুরসহ সকলকে নিয়ে কোনমতে দিন পার করছেন তিনি। আদৌ কি চোখের সঠিক চিকিৎসা হবে? এই অজানা প্রশ্ন বুকে নিয়েই চলছে তার দিনকাল।
জয়পুরহাট শহরের পৌর এলাকার ৬ নং ওয়ার্ড প্রফেসরপাড়া মহল্লার হোটেল শ্রমিক মোকলেছুর রহমান (৫৩) ও রহিমা বেগম (৪০) এক ছেলে এক মেয়ে ও ছেলে বউকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছেন দীর্ঘদিন ধরে। মোকলেছুরের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের পার্বতীপুরে হলেও জীবিকার তাগিদে তিনি ৪০ বছর আগে জয়পুরহাট আসেন। জয়পুরহাট এসে তিনি বিভিন্ন হোটেলে শ্রমিকের কাজ শুরু করেন। প্রফেসরপাড়া মহল্লায় একটি ভাড়া বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। ছেলে আকিবুল হাসান রকি (২৫) এসএসসি পাশ করার আগেই ঢাকার নারায়ণগঞ্জে একটি টেক্সটাইল কোম্পানীতে চাকরি শুরু করেন। মেয়ে শাহিদা খাতুন ৯ম শ্রেণীতে পড়ে। সকলকে নিয়ে চলছিল ভালোই। কিন্তু হঠাৎ তাতে ছন্দপতন ঘটে। একেবারে অকূল সাগরে পড়েছেন, কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তারা।
রকির আহত হবার ঘটনা সর্ম্পকে জানতে চাইলে তার বাবা মোকলেছুর রহমান কান্নাজড়িত কন্ঠে বাসস’কে বলেন, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বিভিন্ন কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার ছেলে রকি ঢাকা থেকে জয়পুরহাট চলে আসে। এসে সে দিনের সবসময় শহরেই থাকতো। গত ৪ আগস্ট রকি সকাল থেকে শহরের জিরো পয়েন্ট পাঁচুরমোড়ে অবস্থান করছিল। সেখানে সে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শরীক হয়। সকাল থেকে আন্দোলনে থাকে সে। বেলা ১২ টা থেকে সাড়ে ১২ টার দিকে পাঁচুরমোড়ে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। এ সময় রকির পুরো শরীরে ৬০ থেকে ৬৫ টি ছররা গুলি লাগে। ছাত্ররা তাকে জয়পুরহাট জেলা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ডাক্তার তাকে ভাল কোন হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। সেখান থেকে তাকে ঢাকার আগারগাঁও চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় দু’মাস চিকিৎসা দেওয়া হয় রকিকে। এ সময়ে চোখের বেশকিছু গুলি বের করলেও এখনও একটি রয়ে গেছে বলে ডাক্তাররা জানিয়েছেন। বর্তমানে রকি বাম চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু ডান চোখে দেখতে পান না। বিভিন্ন প্রকার চেকআপ করার পর ডাক্তার বলেছে, তাকে যদি দেশের বাইরে কোন ভাল চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয় তাহলে তার দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাবার সম্ভাবনা রয়েছে।’
এ বিষয়ে রকি’র স্ত্রী নূপুর আকতার (১৮) এর সাথে কথা বললে তিনি বাসস’কে বলেন, আমার স্বামী দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে লড়াই করতে গিয়ে আজ অন্ধ। আমার পরিবার এখন চলবে কিভাবে? সরকারের এদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। আহত হবার পর থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কেউ সহযোগিতা করেনি। কিছুদিন আগে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ১ লাখ টাকা ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫ হাজার টাকা সহযোগিতা করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রতিবেশী এ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান বলেন, রকি আমার প্রতিবেশী। সে অত্যন্ত ভাল স্বভাবের, শান্ত প্রকৃতির একটি ছেলে ছিল। সে ঢাকায় চাকরি করতো। তার বাবা হোটেলে কাজ করতো। দুজনের আয়ে সংসার ভালই চলতো। কিন্তু এখন অসুস্থ হওয়ায় চাকরি অনিশ্চিত। তাছাড়া রকির বাবা সবসময় ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে তারও কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এখন পরিবারটি অসহায় অবস্থায় আছে। বর্তমান সরকার যদি রকির উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং পরিবারটির সহায়তার কোন উদ্যোগ নেয় তাহলে তারা বেঁচে যায়। আর আমরা প্রতিবেশী এবং জেলাবাসীও সরকারের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক আফরোজা আক্তার চৌধুরী বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আহতদের তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকাতে রকির নাম আছে। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জুলাই ফাউন্ডেশনে তালিকা দিয়েছি। আগামীতে সরকারি যে কোন সাহায্য সহযোগিতা পেলে তাকে দেওয়া হবে। এছাড়া তার পরিবারের জন্য জেলা প্রশাসকের দরজা সবসময় খোলা আছে। যে কোন সমস্যা হলে প্রশাসনকে জানালে তা সমাধান করে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করবো।’