শিরোনাম
প্রতিবেদন : আসাদুজ্জামান
সাতক্ষীরা, ২০ জানুয়ারী, ২০২৫(বাসস) : মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস আগেও মাদ্রাসা ছাত্র আলী হাসান তার নিজের দু’পায়ে ভর করে সহপাঠিদের সাথে খেলাধুলা করতেন। নিয়মিত মাদ্রাসায় যেতেন। আজ তার একটি পা নেই। তিনি আজ পঙ্গু, পরনির্ভর ও অসহায়।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুখানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর আনন্দ মিছিলে যান সাতক্ষীরার আশাশুনির প্রতাপনগর গ্রামের ৯ম শ্রেণির মাদ্রাসা ছাত্র আলী হাসান। আর এই আনন্দ মিছিলে গিয়েই তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। আনন্দ মিছিলে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ছোঁড়া পর পর ৭টি গুলি তার ডান পায়ে লাগে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে নেয়া হয় ঢাকার হৃদরোগ হাসপাতালে। সেখানে একটি অপারেশনের পর পাঠানো হয় পঙ্গু হাসপাতালে। এই হাসপাতালে একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পায়ের অস্ত্রোপচার শেষে জীবন বাঁচাতে তার তার ডান পায়ের হাঁটুসহ নিচ পর্যন্ত কেটে বাদ দেন। আর সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেন আলী হাসান। বর্তমানে তিনি এক পায়ের ওপর ভর করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এদিকে, একমাত্র ছেলে পঙ্গুত্ব বরণ করায় তার পরিবারে নেমে এসেছে ঘোর অনামিশা।
আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের দিনমজুর শাহীন আলম (৪২) এর দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে আলী হাসান (১৬)। সে প্রতাপনগর এবিএস ফাজিল মাদ্রাসার ৯ম শ্রেণির ছাত্র। আলী হাসানের মায়ের নাম জোছনা খাতুন (৩২)। তিনি একজন গৃহিণী। তার ছোট বোনের নাম শাহারিয়া সুলতানা (৮)। সে কুড়িকাউনিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে।
এক পা হারানো আলী হাসান বলেন, গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বিকালে আনন্দ মিছিলে যোগ দেয় এলাকার অসংখ্য মানুষ। তাদের সাথে আমিও যোগ দেই। মিছিলটি প্রতাপনগরের তালতলা বাজার থেকে বের হয়ে নাকনা গ্রামের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের বাড়ির সামনে গেলে জাকিরসহ আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আমাদের শান্তিপূর্ণ আনন্দ মিছিল লক্ষ্য গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। আমরা কয়েকজন আহত হই। তিন জন ঘটনাস্থলে মারা যায়।
আলী হাসান আরো বলেন, ‘আমার ডান পায়ে পর পর ৭টি গুলি লাগে। এর মধ্যে তিনটি গুলি আমার হাঁটুতে, তিনটি হাঁটুর নিচে ও অপর একটি আমার হাঁটুর ওপর থাইতে লাগে। এরপর স্থানীয়রা আমাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে আমার স্বজনদের খবর দেন। পরে তারা আমাকে সেখান থেকে প্রথমে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে আমার অবস্থার অবনতি হলে নেয়া হয় ঢাকার হৃদরোগ হাসপাতালে। সেখানে পায়ের রগে অপারেশনের পর আমাকে পাঠানো হয় পঙ্গু হাসপাতালে। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আমার পায়ের অস্ত্রোপচার শেষে ডান পায়ের হাঁটুসহ নিচ পর্যন্ত কেটে বাদ দেন। তবে, আমার হাঁটুর উপরের থাইতে একটি গুলি এখনো রয়ে গেছে। সেটা বের করা যায়নি।’
বর্তমানে পঙ্গু ও গুলিবিদ্ধ আলী হাসানকে লাঠির ওপর ভর করে জীবন চালাতে হচ্ছে। অথচ এই কিশোরের ছিল দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। স্বপ্নের কুঁড়ি ফুটতে না ফুটতেই কিশোর আলী হাসানের জীবন থমকে গেলো। অবরুদ্ধ হয়ে গেলো চারপাশ। তাই আবেগজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে একটি সরকারি চাকুরি করবো এবং সংসারের হাল ধরবো। আমার সে অশা আজ নিরাশায় পরিণত হয়েছে।’
আলী হাসানের মা জোছনা খাতুন কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, আমার এক মাত্র ছেলে আলী হাসান। তার বড় ইচ্ছে ছিল, লেখাপড়া শেষ করে একটা সরকারি চাকুরি করবে। সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেলো! আদরের ছেলের দিকে তাকালে আমার বুকটা ভেঙে যায়। কিছুদিন আগেও আমার ছেলে আর দশটা ছেলে মেয়ের মতো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতো। এখন তার একটি পা নেই। লাঠির ওপর ভর করে আমার ছেলে চলাফেরা করছে। আমি মা হয়ে এটা সইতে পারি না।
তিনি আরো বলেন, ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিজেদের যা ছিল তা সবই শেষ হয়ে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন আত্নীয় স্বজনের কাছ থেকে টাকা পয়সা ধার নিয়েছিলাম। কিন্তু এখনো সব শোধ করতে পারিনি। কপালে কি যে আছে তা মহান আল্লাহ পাকই জানেন। তিনি এসময় তার ছেলের সুস্থতার জন্য সবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন।
আলী হাসানের বাবা শাহীন আলম বলেন, অল্প একটু জমি ছিল সেটি বন্ধক রেখে এবং আত্নীয় স্বজনের কাছ থেকে টাকা পয়সা ধার নিয়ে প্রায় আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ টাকা ছেলের চিকিৎসার পেছনে খরচ করেছি।
এখন আমি চরম আর্থিক সংকটে দিন কাটাচ্ছি। ধারের টাকা এখন কিভাবে পরিশোধ করবো তাই নিয়ে ভাবছি।
তিনি এ সময় আক্ষেপ করে বলেন, সরকারি ও বেসরকারিভাবে কারো কাছ থেকে তেমন কোন সাহায্য সহযোগিতা পাইনি। তিনি এ সময় বর্তমান সরকারের কাছে তার ছেলের উন্নত চিকিৎসার দাবি জানান।