বাসস
  ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২
আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৭

বাবার কোলেই থাকতে চেয়েছিল শিশু আহাদ, এখন শুয়ে আছে কবরে

শিশু আব্দুল আহাদ

 

প্রতিবেদন: আনিচুর রহমান

ফরিদপুর, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার নারকীয় হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পায়নি চার বছরের শিশু আব্দুল আহাদও। নিজ বাড়ির বারান্দাতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে মারা  যায় সে।

জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গত ১৯ শে জুলাই কদমতলী থানার রায়েরবাগ বি ব্লক মিরাজনগর তিন রাস্তার মোড়ে ছাত্র-জনতা এবং ছাত্রলীগের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় উভপক্ষে ইট পাটকেল ছোঁড়াছুড়ি ও সংঘর্ষ চলে। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এমনকি হেলিকপ্টার থেকেও গুলি ছোঁড়া হচ্ছিল। কাছেই এগারো তলা ভবনের আট তলার বারান্দায় ছিলো আব্দুল আহাদ। পাশে ছিল বাবা ও মা। এ সময়ে একটি গুলি এসে বাচ্চাটির শরীরে বিদ্ধ হয় এবং সে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। 

আহাদের বাবা মোঃ আবুল হাসান (৩৪) আয়কর বিভাগের করাঞ্চল-৮ এ উচ্চমান সহকারী পদে কর্মরত আছেন।  তিনি ঢাকার রায়েরবাগ মিরাজনগর শান্তি নিবাস-২ নামক এগারতলা ভবনের আট তলার একটি ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার পুখুরিয়াতে।

আহাদের বাবা মো: আবুল হাসান বলেন, আমার দুই সন্তান। বড় ছেলে মেহেরাজ হাচান দিহান (১২)। মাদ্রাসায় হিফজ পড়ে এবং মাদ্রাসাতেই থাকে। বাসায় আমি, আমার ছোট ছেলে আব্দুল আহাদ ও আমার স্ত্রী থাকতাম। 

তিনি বলেন,  গত ১৯শে জুলাই স্ত্রী এবং আহাদকে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। ও আমাদের দুজনের মাঝখানে ছিল। এ সময়ে একটি গুলি এসে তার শরীরে লাগে। গুলিটি আহাদের ডান চোখের উপর দিয়ে ঢুকে মাথার ভেতরে প্রবেশ করে। সন্তানের রক্তাক্ত শরীর কোলে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দৌড়াই। সেখানে ভর্তির পর আইসিইউতে নেয়া হয়। ওর অবস্থা বেশি খারাপ হলে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ২০ জুলাই রাত ৮:৩০ মিনিটে ও মারা যায়।

আহাদের বাবা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, যেদিন ও গুলিবিদ্ধ হয় ঐদিন সকালবেলা আমাকে বলছিল তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখো বাবা, তুমি আমাকে ছেড়ে দিও না। তোমার বুকের ভেতর থাকতে আমার খুব ভালো লাগে। 

আমি তাকে বললাম, আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবো না। ও আমাকে আবারো বলল, বাবা তুমি যাবে না।তুমি যেখানে যাবে আমাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু ছেলেটা আমাদেরকেই ছেড়ে চলে গেল। একজন বাবার চোখের সামনে তার সন্তানের এমন মৃত্যু যে কতটা কষ্টকর সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। 

তিনি আরো বলেন, ওর স্মৃতিগুলো আমাকে খুব কাঁদায়। আমার আহাদ খুব চঞ্চল প্রকৃতির ছেলে ছিল। ছিল খুব মিশুক। সবাইকে সহজে আপন করে নিত। পরিবারের সবাই ওকে খুব ভালোবাসতো। সারাক্ষণ দুরন্তপনায় বাসা মাতিয়ে রাখত। আমার ঘর ভর্তি ওর খেলনা। আমি যখন অফিসে থাকতাম তখন সে আমায় মোবাইলে ভিডিও কল দিয়ে বলতো, বাবা আমার জন্য খেলনা নিয়ে আসবে।বাইরে থেকে আসলেই তার জন্য খেলনা নিয়ে আসতে হতো। বাইরে কখনো ঘুরতে বের হলে তার পছন্দের খাবার চাওমিন অথবা চিকেন ফ্রাই খেতে চাইত। সে অপেক্ষায় থাকতো কখন বাবা বাসায় আসবে। তার সাথে সময় কাটাবে। তার সাথে গল্প করবে ছোট্ট ছোট্ট গাড়িগুলো নিয়ে খেলাধুলা করবে।

ছেলেকে নিয়ে তার স্বপ্নের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল তাকে আমি বড় ছেলের মত মাদ্রাসায় পড়াবো।বিগত সরকারের অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং খামখেয়ালির কারণে আজ আমি সন্তানহারা।আমার সন্তানকে স্বৈরাচারী সরকার শেখ হাসিনা হত্যা করেছে। আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।’

কেবল আহাদের বাবা নন, সন্তানকে হারিয়ে পাগল প্রায় মা কোহিনুর আক্তার সুমি (২৬)। চোখের সামনে সন্তানের এমন করুণ মৃত্যু কোনভাবেই যেন মেনে নিতে পারছে না মায়ের অবুঝ মন। 

আহাদের মা বলেন, ওর বাবা সারাদিন অফিসে থাকে। আর আমি ওকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। রাতে ও আমার কোলের ভেতরে ঘুমাতো। এখন আর ও নেই। কে আমার কোলে ঘুমাবে? ছেলেটা আমাকে আর মা বলে ডাকে না। আমার ছোট্ট শিশুর জন্য দিগ বিদিক হয়ে ছোটাছুটি করি, তবু আমার সন্তান আমার কোলে আর ফিরে আসে না। সন্তানের কথা মনে পড়লেই চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারি না।ছোট্ট এই শিশুটিকে নিয়ে সারাক্ষণ আমার ব্যস্ততায় কাটতো। এখন যেদিকেই তাকাই সেদিকেই ওর স্মৃতি। ওর খেলনা গুলো পড়ে আছে। রাতে যখন ঘুমাতে যেতাম তখন ও আমায় সূরা ফাতেহা ও সূরা ইখলাস পাঠ করে শোনাতো। আর ঘুমানোর সময় দোয়া পড়তো। খাবার বসে কি দোয়া পড়তে হয়, খাবার শেষ হলে কি দোয়া পড়তে হয় সে সব পড়তো এবং খাবার শেষ হলে আলহামদুলিল্লাহ বলতো।

তিনি বলেন, আমি আমার কলিজার টুকরো আব্দুল আহাদের হত্যাকারীরদের বিচার চাই।আমার কোলের শিশুকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে আল্লাহ তাদের বিচার করবেন। হে আল্লাহ তুমি তো সবকিছু দেখো, তোমার কাছে বিচার দিলাম, যারা আমার বুক খালি করে দিছে তুমি তাদের বুকও খালি করে দিও।

আহাদের এমন মৃত্যু মেনে নেয়ার মত নয় বলে অঝোরে কাঁদতে থাকেন চাচা করিম মাতুব্বর। চাচা বলেন, ওরা বাড়িতে আসলেই ও আমার সাথে মসজিদে নামাজ পড়তে যেত। খুব চঞ্চল ছিল। আমরা না হয় দোষে গুণে মানুষ। কিন্তু ছোট মাসুম বাচ্চার কি অপরাধ ছিল! তাকে এভাবে কেন হত্যা করা হলো? আমরা এই হত্যার বিচার চাই। 

স্থানীয় বাসিন্দা মো: মোখলেসুর রহমান বলেন, এটি হৃদয় বিদারক ঘটনা। আমরা এলাকাবাসী সবাই বিষয়টি নিয়ে মর্মাহত। পারিবারিকভাবে যে ক্ষতি হলো সেটি অপূরণীয়। আমরা ওকে তো আর ফেরত পাব না। এরকমভাবে কোন মায়ের কোল যেন আর খালি না হয়। 

আহাদের স্মৃতি যেন মানুষ চিরকাল স্মরণে রাখে সেজন্য কিছু করার আহ্বান জানান তিনি সরকারের কাছে। আর নিরপরাধ শিশুটিকে হত্যার বিচার চান।