বাসস
  ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪:৩৯
আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪:৫৬

স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করাবেন, এখন দু’ছেলের স্কুলে যাওয়াই বন্ধ আহত রবিন দাসের

রবিন কুমার দাস -ছবি : বাসস

প্রতিবেদন: রোস্তম আলী মন্ডল

দিনাজপুর, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): আমার পুরো শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা করে। রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারি না। তবুও পরিবারের জন্য কষ্ট করে খাবার জোটাতে চায়ের দোকানে বসি। আমার মত দরিদ্র মানুষকে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুলি করে ও মেরে কি তৃপ্তি পেয়েছে, আমি এখনো বুঝে উঠতে পারি না। 

সম্প্রতি কথা হয় দিনাজপুর শহরের কাচারী এলাকার দরিদ্র চা দোকানদার রবিন কুমার দাস (৪২) এর সাথে। 

দিনাজপুর শহরের কাচারী এলাকায় জেলা রেজিস্ট্রার অফিসের সামনে মাসিক এক হাজার টাকা ভাড়ায় নেয়া দোকানে গত দু’বছর থেকে রবিন তার স্ত্রী রুপালী দাসকে সাথে নিয়ে চা, বিস্কুট, বুট-মুড়ি বিক্রি করছেন। চায়ের দোকানে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে তার বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও সন্তানসহ কোন রকমে জীবন যাপন করে আসছিলেন।

গত ৪ আগস্ট প্রতিদিনের মতো রবিন তার স্ত্রী রুপালী সহ চায়ের দোকানে কাজ করছিলেন। হঠাৎ করে ওই দিন দুপুরে তার দোকানে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছেলে-মেয়েরা এসে আশ্রয় নেয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা, অস্ত্র ও লাঠি হাতে তার দোকানে এসে, ওই আন্দোলনকারী ছেলেমেয়ে গুলোকে বেধড়ক মারপিট শুরু করে। তখন ছেলেমেয়ে গুলো দোকান থেকে দৌড়ে বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ওই ছেলেমেয়ে গুলোকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু  করে। প্রাণ বাঁচাতে ছেলেমেয়ে গুলো দৌড় দিয়ে নিমেষের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে যায়। 

এরপর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রবিনের ওপর চড়াও হয়। তারা তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। তারা রবিনকে বলে, ‘ব্যাটা তুই নেতা হয়ে গেছিস। এসব আন্দোলনকারী ছেলেমেয়েদের তুই তোর দোকানে আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতা করিস’। রবিন তাদের নিকট হাত জোড় করে বলেন, ‘স্যার আমি গরিব মানুষ, চা দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করি।আমার দোকানে সবাই আসে, আমি কাউকে বাধা দেই না। যারা এসেছিল তাদেরকে আমি চিনি না। হঠাৎ করে তারা আমার দোকানে ঢুকে পড়েছে, আমি কি করবো স্যার। এরপরও তারা তার কোন কথা শোনেনি। দূর থেকে একজন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য রবিনের বাম পায়ের হাঁটুর নিচে পর পর দু’রাউন্ড গুলি করে। আর অন্যান্য সদস্য তার দোকানের চালা উল্টিয়ে দেয়। 

এই অবস্থা দেখে, রবিনের স্ত্রী রূপালী দাস আইন শৃঙ্খলা  বাহিনীর সদস্যদের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করতে থাকেন। তিনি হাত জোড় করে তাদের বলেন, ‘স্যার আমাদের দোকানটা ভেঙ্গে দিয়েন না। আমরা এই দোকানের আয় দিয়েই সংসার চালাই। আমাদের রোজগার করার মত আর কিছু নেই।’ 

কিন্তু কে শোনে কার কথা, তারা দোকানটা ভেঙ্গে চুরে চলে যায়। রবিন গুরুতর আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকেন। পরে তার স্ত্রী দুই শিশু পুত্রকে নিয়ে কোন রকমে দিনাজপুর সদর হাসপাতালে রবিনকে নিয়ে যান। 

তারা সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখেন, পা রাখার মত জায়গা নেই। আহত রোগীর ভীড়ে হাসপাতালে বারান্দা ও মেঝে ভরে গেছে। 

সদর হাসপাতালের চিকিৎসক এডভোকেট বিধান কুমার দেবের জামাই ডাঃ পরিমল কুমার সরকার তাদের দেখে কাছে এগিয়ে আসেন। 

তিনি সব শুনে রবিনের স্ত্রীকে বলেন, ‘কিছু ঔষধ দিচ্ছি। তুমি ওকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে এই ঔষধ গুলো খাইয়ে দাও। এখন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার মতো পরিবেশ নাই।’ 

এরপর রবিনের স্ত্রী অতি কষ্টে রবিন ও বাচ্চাদের নিয়ে শহরের বালুবাড়ীর বাড়িতে ফিরে আসেন। রবিনের এই অবস্থা দেখে, তার ৭৫ বছর বয়সের বৃদ্ধা মা তারামনি দাস হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকেন। 

এদিকে ডাক্তারের দেয়া ঔষধগুলো খাইয়ে দেয়ার পরও শরীরের মধ্যে গুলি থাকায় আহত রবিন কোন স্বস্তি পাচ্ছিলেন  না। ব্যথায় কোঁকাচ্ছিলেন। এছাড়া শহরে চতুর্দিকে গোলযোগের কারণে কারো সাথে যোগাযোগ করতেও পারছিলেন না। ফলে ওই দিন সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত অনেক কষ্টে ঘুমবিহীন অবস্থায় ঘরেই থাকেন। তার সাথে তার স্ত্রী রূপালী দাস, বৃদ্ধা মা ও ছোট দুই শিশু সন্তান সবাই রাত জেগে ছিল। পর দিন ৫ আগস্ট, দুপুরে কোন রকমে তাকে নিয়ে তার স্ত্রী সদর হাসপাতালে যান। সেখানে ডাক্তার পরিমল বাবু রবিনকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নেন। হাসপাতালে কোন বেড ফাঁকা ছিল না, সে কারণে রবিনকে, হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতেই থাকতে হয়। হাসপাতালে সাত দিন পর ১৩ আগস্ট দুপুরে রবিনের বাম পা থেকে দুটি স্টীল বুলেট অপারেশনের মাধ্যমে ডাক্তার বের করে নেন। বাম হাতের কনে আঙুলের দু’টি হাড় ভেঙ্গে গেছে বলেও ডাক্তার জানায়। এক্সরেতেও তার সত্যতা ধরা পড়ে। পরে হাসপাতালে থেকে আর চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়না রবিনের।

এরপর থেকে রবিন নিজের বাড়িতেই অবস্থান করতে থাকেন। আর ডাক্তার দেয়া ঔষধ খেয়ে কষ্ট করে দিন কাটাচ্ছেন। মাঝে মধ্য স্ত্রী রুপালীকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে চেকআপ করান। চেক-আপ হাসপাতালের ডাক্তার শিলা দত্তের অধীনে রবিনের  চিকিৎসা চলছে।  

তবে আগের তুলনায় রবিন কিছুটা সুস্থ হয়েছেন। কিন্তু বাম হাতের ভাঙ্গা জায়গাটা অপারেশন করার মত কোন ব্যবস্থা এখনও করা যায়নি। 

এদিকে স্ত্রী ছিলেন গর্ভবতী। ইতোমধ্যে তিনি একটি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছেন। 

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুরুতর আহত চা দোকানদার রবিন বলেন, দুই শিশু পুত্র গোবিন্দ দাস (১০) ও নবকুমার দাস (৭) এবং এখন আর এক ছোট শিশু কন্যা গৌরী দাস সহ ৩ টি সন্তান আমার। তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে শরীরের এ অবস্থাতেই গত ৩০ নভেম্বর থেকে কাচারীতে কোন রকমে আবার চা-বিস্কুটের দোকান শুরু করেছি। কিন্তু ভাঙা হাত নিয়ে ঠিকমত দোকানদারি করতে পারি না। 

রবিন কুমার দাস ও তার পরিবার   -ছবি : বাসস

এদিকে রবিন অসুস্থ থাকায় তার ছেলে গোবিন্দ দাস ও নব কুমার দাসের স্কুলে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে। এক মাসের শিশু বাচ্চাকে চায়ের দোকানে শুইয়ে রেখে তার স্ত্রী দোকানদারিতে সাহায্য করছেন। এভাবে দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে চলছে রবিনের পরিবার। 

এদিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আহতদের তালিকায় রবিনের নাম রয়েছে। সেখান থেকে তিনি ভাঙা হাতের চিকিৎসায় সহায়তার আশ্বাস পেয়েছেন। 

আহত রবিনের মা তারামনি কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, হঠাৎ করে আমার ছেলে রবিন আহত হওয়ায়, আমরা খুব কষ্টের মধ্যে আছি। এমনি তো আমাদের নিজস্ব কোন থাকার জায়গা নেই। অন্যের জায়গায় ঘর করে বসবাস করছি। এর মধ্যে আমার ছেলে রবিন দাস আহত হয়ে পড়ে থাকায়, কিভাবে তার চিকিৎসা হবে, আর আমি ও আমার ছেলের বউ ও তার শিশু ছেলে-মেয়েরা কি খেয়ে বেঁচে থাকবে এসব চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি না। আমি নিজেই বার্ধক্য ও রোগে আক্রান্ত হয়ে গত ৬ বছর থেকে শয্যাশায়ী হয়ে আছি। আমি কার কাছে বলবো এসব দুঃখ ও কষ্টের কথা? 

তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার আমার এই আহত ছেলেটার চিকিৎসা করে সুস্থ করে দিক। যাতে আমার ছেলেটা আবার কামাই রোজগার করে বউ, বাচ্চা নিয়ে দিন চালাতে পারে।’ 

রবিনের স্ত্রী রূপালী দাস বলেন, আমার স্বামী একজন সহজ সরল মানুষ। আমি ও আমার স্বামী কেউ লেখাপড়া জানি না। আমার দুই শিশু পুত্রকে লেখা-পড়া করাতে চেয়েছিলাম। কিন্ত দুর্ভাগ্য আমাদের, খাবারই জোটে না এখন। পড়াবো কি করে? ছেলে দু’টার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

তিনি বলেন, সংসারে রোজগার করার মানুষটা আমার স্বামী, হাত পা ভেঙ্গে গত প্রায় ছয়মাস মাস থেকে পড়ে আছে। আমি এক মাসের শিশু কন্যা সন্তান সহ দুই নাবালক পুত্রকে নিয়ে কোন রকমে চায়ের দোকান চালিয়ে আসছি। আমার স্বামীর হাতের চিকিৎসা কবে হবে, কবে তিনি ভালো হবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। 

তিনি হাহাকার ভরা কন্ঠে প্রশ্ন করেন, আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে কে? কে আমাদের সাহায্য করবে? 

তিনি সরকারের কাছে তার স্বামীকে চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার দাবি জানান।

এ বিষয়ে ডাক্তার পরিমল কুমার সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, রবিন দাস একজন চায়ের দোকানদার। সে আমার শ্বশুরের জমিতে ঘর তুলে তার বৃদ্ধা মা সহ থাকে। তার এই অবস্থা দেখে আমি মানবিক ভাবে ফ্রি ঔষধপত্র দিয়ে তাকে সহযোগিতা করে আসছি। এ ছাড়া আমি বেসরকারি হাসপাতাল চেক-আপ এর মালিক সার্জারি ডাক্তার শিলা দত্তকে বলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা ফ্রি করে দিয়েছি। আরও কিছু করার চেষ্টায় আছেন বলে জানালেন ডাক্তার পরিমল কুমার।

দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ রফিকুল ইসলামের কাছে আহত রবিন দাসের বিষয় জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে এই জেলায় যারা আহত হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের সরকারি ভাবে তালিকা করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী চিকিৎসা করতে সিভিল সার্জনকে বলা হয়েছে। 

যারা আহত প্রত্যেকের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেন।