বাসস
  ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫:৩৯

‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা কেড়ে নিয়েছে আমার সকল সুখ’- শহিদ বিপ্লবের মা

প্রতিবেদন: মো: আব্দুল কাইয়ুম

ময়মনসিংহ, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার চুড়ালী গ্রামের জরাজীর্ণ এক টিনশেড ঘর। পলিথিনে মোড়ানো সেই ঘরের ভেতরে এখন শুধুই শূন্যতা আর কান্নার আওয়াজ। এখানেই তিন সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন বাবুল মিয়া ও বিলকিস আক্তার। কিন্তু ২০ জুলাইয়ের সেই ভয়াল দিনটি সবকিছুই লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে একটি পরিবার। সেদিন শহিদ হয়েছে তাদের বুকের ধন, ১৯ বছরের বিপ্লব হাসান।

মা বিলকিস আক্তার ছেলের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমি কোনোদিন ছেলেকে একটা থাপ্পড়ও মারিনি। কিন্তু শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশ আমার সন্তানকে মাটিতে ফেলে, মুখে বুট দিয়ে চেপে ধরে গুলি করেছে। এ ঘটনা সবাই দেখেছে।’ এ সময়ে প্রতিটি শব্দের সাথে মায়ের কণ্ঠে যেন পুরো পৃথিবীর শোক আর অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছিল।

বিপ্লবের জীবনের গল্পও কম কষ্টের ছিল না। বাবা বাবুল মিয়া রিকশা গ্যারেজের মিস্ত্রি ছিলেন। কিন্তু কোমরের হাড় ক্ষয়ে যাওয়ায় আগের মতো কাজ করতে পারেন না। সংসারের খরচ চালাতে স্থানীয় কিষাণী ওয়েল মিলে চাকরি নিয়েছিলেন বিপ্লব। নিজের স্বপ্নকে পেছনে ফেলে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হয়েছিল তাকে। কাজ আর পড়াশোনার চাপে ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায়ও অকৃতকার্য হন তিনি। তবু বিপ্লব হাল ছাড়েননি। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

গত ১৯ জুলাই রাতে বিপ্লব মাকে পরদিন ডিউটিতে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। তাই মা ভোরে রান্না শেষ করেন। কিন্তু ছেলে মাছ পছন্দ করত না, তাই সকালের খাবার না খেয়েই বন্ধুদের ফোন পেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আর তখন থেকেই মায়ের বুকের ভেতর একটা অজানা যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার চূড়ান্ত রূপ পেলেন সাড়ে ১২টার দিকে, যখন শুনলেন তার ছেলেকে গুলি করা হয়েছে।

মা বিলকিস আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বিপ্লবের লাশ আনতে গিয়ে দেখেছি ওর গালে পুলিশের বুটের ছাপ। কপালে আর গলায় গুলির আঘাত। আমার নাড়ি ছেঁড়া ধনটাকে ঘরের পাশেই দাফন করতে হলো, পুলিশের চাপের মুখে। আমি কিছু করতে পারিনি।’

এই ঘটনার পর পুরো পরিবার অন্ধকারে ডুবে গেছে। কীভাবে চলবে সংসার? মেয়েদের লেখাপড়া কীভাবে চালাবেন? এসব প্রশ্নের জবাব মায়ের কাছে নেই।

তিনি বলেন, ‘আমার উপার্জনক্ষম ছেলেকে মেরে সব শেষ করে দিয়েছে খুনি হাসিনা। আমাদের সুখ কেড়ে নিয়েছে। এখন কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।’

বিলকিস জানান, বিপ্লব মাস শেষে তার বেতনের পুরো টাকা মায়ের হাতে তুলে দিত। খরচের টাকা মায়ের কাছ থেকে চাইত। মাকে কখনো বাড়ির বাইরে যেতে দিত না। বিপ্লব কোনো রাজনীতি করত না।

গত ২০ জুলাই ঘটনার দিন, বিপ্লবের বাবা বাবুল মিয়া সিলেটে ছিলেন। ছেলের শেষ কথাগুলো এখনো তার কানে বাজে। ফোনে বলেছিল, ‘বাবা তুমি সাবধানে থেকো, দেশে গণ্ডগোল চলছে।’ যে ছেলে বাবাকে সাবধান করেছিল, সেই ছেলে নিজেই গুলিতে প্রাণ হারাল।

বাবা এখন নির্বাক। মা বিলকিস প্রতিদিন সন্তানের কবরের পাশে বসে কাঁদেন। সন্তানের শূন্যতা আর স্মৃতিতে তাদের জীবনে নেমে এসেছে এক অনন্ত অন্ধকার। এই পরিবার শুধু তাদের প্রিয়জন হারায়নি, হারিয়েছে জীবনের সব স্বপ্ন, সব আশার আলো।