শিরোনাম
প্রতিবেদন: বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : জন্মের পাঁচ মাস পার হতে না হতেই বাবা হারা হলো আনিশা। তার বাবা শহিদ হয়েছেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। তার বাবার নাম মো. রিটন উদ্দিন।
রিটনের তিন শিশু সন্তান রয়েছে। এই সন্তানদের উৎসুক চোখ এখন কেবল বাবাকেই খোঁজে। বাবার বয়সী কাউকে দেখলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তারা। এদিকে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন রিটনের স্ত্রী আফসানা বেগম।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলাকায় রিটন উদ্দিন (৩২) আকিজ গ্রুপের সেলস ম্যানের চাকুরি করতেন। তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ছিল তার সংসার। আছেন বাবা-মা ও ছোট ভাই-বোন। চাকুরির কারণে রিটন ঢাকায় থাকতেন। সন্তান ও স্ত্রী থাকতো গ্রামে।
রিটন গত ৫ আগস্ট বিকেলে যাত্রাবাড়ি এলাকায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। তাকে হারিয়ে নিঃস্ব এখন পরিবার। কান্না থামছে না সন্তানদের ও বাবা-মায়ের।
রাজধানীর বংশাল থানার ৮৪/এ কসাইটুলির বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদ মো. রিটন উদ্দিনের ছোট ভাই আরিফ উদ্দিন এসব কথা জানান।
রিটনের বাড়ি নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার নলচিরা ইউনিয়নের লামছড়ি গ্রামে। বাবা আবুল কালাম (৬০) ও মা নাসিমা বেগম (৪৮)। বাবা ২০০৮ সালে একবার এবং ২০১২ সালে আবারো স্ট্রোক করেন। এর পর থেকেই তিনি অসুস্থ। অসুস্থতার কারণে তিনি আর কোন কাজ করতে পারেন না। সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়।
শহিদ রিটনের স্ত্রীর নাম আফসানা বেগম (২৯)। রিটনের দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। বড় ছেলে আব্দুর রহমান রিহান (১০), মেজ ছেলে আতিকুর রহমান হৃদয় (৮) এবং মেয়ে আনিশা রহমান। তার বয়স মাত্র ১১ মাস। তার বয়স পাঁচ মাস না পেরুতেই সে পিতৃহীন হলো। ছেলে রিহান ও হৃদয় গ্রামের বাড়িতে স্থানীয় স্কুলে পড়ালেখা করছে।
রিটনের স্ত্রী আফসানা বলেন, ‘আমার স্বামী খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। কোন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। কিন্তু আল্লাহ আমার কপালে সুখ লিখে রাখেনি, তাই আমার স্বামীকে অসময়ে নিয়ে গেলেন।’
তিনি কান্না করতে করতে প্রশ্ন করেন, তাদের সুখের সংসারে এমন পরিস্থিতি কেন হলো? তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যৎ কি হবে? নিরাপত্তা কে দেবে? সংসার কিভাবে চলবে? তার কোন আয় রোজগার নেই। এসব প্রশ্ন করে তিনি আবার কাঁদতে থাকেন।
পরিবারের বড় ছেলে রিটন উদ্দিনের ছোট ভাই আরিফ উদ্দিন (২৮) ও ছোট বোন মিশু বেগম (২২)।
আরিফ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন। আর বোন মিশু ইডেন কলেজে বাংলা বিভাগে অনার্স চতুর্থ বর্ষে লেখাপড়া করছেন। ভাই-বোনসহ পরিবারের সমস্ত খরচ বহন করতেন রিটন উদ্দিন।
রিটনের ভাই আরিফ উদ্দিন বলেন, ভাই আকিজ গ্রুপে সেলস ম্যানের চাকুরি করতেন। তার দায়িত্ব ছিল যাত্রাবাড়ি এলাকায়। ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেলে, তিনি কাজ বাদ দিয়ে আনন্দ মিছিলে যোগ দেন। তারপর মিছিলটি যাত্রাবাড়ি থানার সামনে গেলে পুলিশের গুলিতে তিনি আহত হন।
প্রথম গুলি তার হাতে লাগে। পরের গুলি পাঁজরের পাশে ঢুকে বের হয়ে যায় এবং তৃতীয় গুলি তার নাভি দিয়ে ঢুকে পেছন দিয়ে বের যায়।
তিনি বলেন, আমার ভাই সরকার বিরোধী যে কোনো আন্দোলনে সমর্থন দিতেন। এর প্রধান কারণ ছিল দুটি।
এক, আওয়ামী সরকারের ইসলাম বিদ্বেষ। দুই, এই সরকার থাকলে আমার চাকুরি হবে না। এরই ধারাবহিকতায় আমার ভাই ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন। সরকারের পতনের খবরে সেদিন ছুটি নিয়ে বিজয় মিছিলে যোগদান করেন। তাকে হারিয়ে আমার বাবা-মা ও তার পরিবার বলতে গেলে পাগল হয়ে গেছে।
এদিকে রিটন শহিদ হওয়ার পরদিন ৬ আগস্ট ২২ হাজার টাকা দিয়ে ট্রাক ও ৫ হাজার টাকা দিয়ে নৌকা ভাড়া করে লাশ নেওয়া হয় তার গ্রামের বাড়িতে। সেখানে জানাজা শেষে পাশেই নানাবাড়ি চরকিং ইউনিয়নের ২২নং গ্রামের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। রিটনের গ্রামের বাড়ি নদী ভাঙ্গাকবলিত হওয়ায় তাকে নানাবাড়ির কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
ভাই আরিফ উদ্দিন আরও বলেন, আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃ-বিজ্ঞানে মাস্টার্স পাশ করেছি। বিগত কয়েক বছর থেকে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় ভাইবা দিয়েছি, কিন্তু আমার কোন চাকুরি হয়নি। তখন ভাইয়ের ধারণা হয়েছিল, এই সরকার থাকলে আমার চাকুরি হবে না। তাই সুযোগ পেলেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার ভাই আন্দোলনে যেত।
কিন্তু তার আন্দোলনে যাওয়ার বিষয়টি আমার ধারণারও বাইরে ছিল। রিটন ১৬ জুলাই থেকে তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে শনিরআখড়া এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। ৫ই আগস্টও তিনি বিজয় মিছিলে যোগ দেন। মিছিলটি যখন যাত্রাবাড়ি থানার সামনে আসে তখন পুলিশের গুলিতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন।
ভাইয়ের সাথে ২ আগস্ট দুপুরে শেষ দেখা হয়েছিল জানিয়ে আরিফ বলেন, ‘ঢাকায় আমরা বংশালের কসাইটুলিতে থাকি। আমি ও আমার বোন এই এলাকায় টিউশনি করি। বাবা-মা ঢাকায়ও থাকেন, আবার গ্রামের বাড়িতেও থাকেন। ভাই চাকুিরর কারণে যাত্রাবাড়ি থাকতেন। প্রতি শুক্রবার ভাই আমাদের বাসায় আসতেন। শুক্রবারে আমি আর ভাই এক সাথে নামাজ পড়তে যেতাম এবং দুপুরের খাবার খেতাম। ২ আগস্ট ভাই এসেছিলেন। আমি তাকে বারবার বলেছি তোমার আন্দোলনে যাওয়ার দরকার নেই। সেদিন পারিবারিক বিষয়ে অনেক কথাই হয়।
তিনি বলেন, ভাই সব সময়ে আমাকে বলতেন, ছোট হলেও একটা সরকারি চাকুরি তুই করবি। এর জন্য যদি আমার শরীরের সব রক্ত দিতে হয় আমি দেব, তাও তোকে সরকারি চাকুরি করতেই হবে। ভাই শহিদ হয়েছেন, জানি না ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো কি না, এই বলে কান্না করতে থাকেন তিনি।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে শহিদ রিটনের ভাই আরিফ বলেন, ৫ আগস্ট সকাল ১১ টার সময়ও আমি তাকে বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু আমার কথা শুনে নাই। আমি তখন শহিদ মিনার হয়ে শাহবাগের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন সময় দুপুর ১ টা ৪০ মিনিটের মত। এমন সময়ে ফোনে আমার বন্ধু জানায় বড় ভাইয়ের গুলি লাগছে।
আমি ভাবছিলাম, হয়তো রাবার বুলেট লাগছে। তাই ওকে বলি দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসতে। আমার বন্ধু অনেক কষ্ট করে ঢাকা মেডিকেলে আমার ভাইকে নিয়ে আসে। পথে আমার ছোট বোনের সাথে আমার বন্ধুর দেখা হয়, তখন তাকেও সাথে নিয়ে মেডিকেলে আসে। ঢাকা মেডিকেলে যখন ভাইকে নিয়ে আসা হয় তখন দেখি ভাইয়ের ডান হাতটা প্রায় বিচ্ছিন্ন। তখন আমি ভাবি হয়তো হাতটা কেটে ফেললে ভাইকে বাঁচানো যাবে। পরে দেখি ভাইয়ের আর একটা গুলি পাঁজরের পাশ দিয়ে ঢুকে বের হয়ে গেছে এবং তৃতীয় গুলি তার নাভি দিয়ে ঢুকে পেছন দিয়ে বের গেছে। এইটা দেখে আমি আশা ছেড়ে দেই। তখন চিকিৎসকরা দেখে তাকে রক্ত দিতে বলেন। আমি তাড়াতাড়ি তিন ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে দেই।
দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পর ভাই মারা যায়।
কারো কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে আরিফ উদ্দিন বলেন, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচলাখ টাকার চেক ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা পেয়েছি।
ছেলের এমন করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না মা নাছিমা বেগম। তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার নির্দোষ ছেলেডারে মাইরা ফেলল। আমার বুক খালি কইরা দিল। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে বাবা আবুল কালাম বলেন, ‘রিটনের ছেলে ও মেয়েসহ আমার পরিবারের নিরাপদ ভবিষ্যত চাই। আমার বড় ছেলের আয় দিয়েই আমার সংসার চলতো। এখন রিটনের তিনটা ছোট সন্তানের কি হবে? কিভাবে চলবে আমাদের সংসার? মেয়েটাকে বিয়ে দিতে হবে। আমি অসুস্থ, মাসে অনেক টাকার ওষুধ লাগে। কি ভাবে যে কি হবে। ছোট ছেলেটাও এখনও চাকরি পায়নি। ওর জন্য যদি সরকার একটি চাকুরির ব্যবস্থা করতো তাহলে আমার পরিবারটা বাঁচতো। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
পাশাপাশি যারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন রাষ্ট্রীয় ভাবে সবাইকে শহিদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।