শিরোনাম
প্রতিবেদন: আককাস সিকদার
ঝালকাঠি, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫(বাসস) : শরীরে ছিলো ১১০টি ছররা গুলির চিহ্ন। বুক থেকে পিঠ পর্যন্ত ছিদ্র করেছে আরেকটি লাইফ বুলেট। ঘটনা ৫ আগস্টের। জীবিকার তাগিদে ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলার সুজন খান পরিবার নিয়ে থাকতেন রাজধানীর কেরানিগঞ্জে। চাকুরি করতেন ইসলামপুরে কাপড়ের দোকানে।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও কাজে বের হয়েছিলেন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে। ছুটি হওয়ার কথা সন্ধ্যা ৭টায়। রুটিন অনুযায়ী রাত সাড়ে ৯টায়ও বাসায় ফেরেননি। সঙ্গে থাকা ফোনটিও ছিলো বন্ধ। রাত ১২টায় সুজনের ফোনটি চালু করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক পরিবারকে জানান আহত হওয়ার কথা।
পরদিন ৬ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৪টায় একই হাসপাতালে মারা যান সুজন (৩০)।
গত ৫ আগস্ট সকালে বাসা থেকে সুজন যখন বের হয়েছিলেন, স্ত্রী জান্নাত আক্তার স্বামীকে শেষ কথা এটুকুই বলেছিলেন, ‘তাড়াতাড়ি বাসায় এসো’। সুজনের স্ত্রী তখন সাড়ে ৪ মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। এই দম্পতির প্রথমে একটি কন্যা সন্তান জন্ম হয় ২০২২ সালের ২১ আগস্ট। মেয়ের নাম রেখেছিলেন নুসরাত জাহান নূর। নূরের বয়স তিন বছর পূর্ণ হওয়ার মাত্র ১৫ দিন আগে সুজন মারা যান।
ইসলামপুরের একই দোকানে সুজনের আরো দুই ভাই সুমন (৩৩), ও সাগর (২৮) চাকুরি করেন। তাদের বড়ভাই রুবেল খান (৩৬) ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাড়িতেই থাকেন। ছোটবোন সুমী আক্তার (২২) বিবাহিত। বাবা বাবুল খান (৬২) ও মা দুলিয়া বেগমের (৫৫) তৃতীয় সন্তান সুজন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।
মা দুলিয়া বেগম জানান, পেটের দায়ে প্রায় ১০ বছর আগে ঢাকায় যান তার ছেলে। এক পর্যায়ে তার তিন ছেলে ও স্বামীর সঙ্গে তিনিও ঢাকার কেরানিগঞ্জে থাকতে শুরু করেন। ২০২১ সালে সেজ ছেলে সুজনকে পারিবারিক ভাবে বিয়ে দেন আবদুল মালেক সরদার ও পিয়ারা বেগমের মেয়ে জান্নাত আক্তারের সঙ্গে। পেশায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক মালেক সরদার পরিবার নিয়ে কেরানিগঞ্জে ভাড়া বাসায় একই জায়গায় থাকলেও তার বাড়ি শরিয়তপুরে।
সুজনের স্ত্রী জান্নাত ২০১৭ সালে দাখিল (এসএসসি সমমান) পাস করেন। তিনি বলেন, ‘দেবরের কাছে শুনেছি আমার স্বামী ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টা বা ১১টার দিকে দোকানের মাল আনতে যাত্রাবাড়ি গিয়েছিলেন।
সেখানেই সম্ভবত তার গায়ে গুলি লেগেছে। রাত ১২টার পরে আমরা জানতে পেরে সবাই হাসপাতালে যাই।
পরের দিন বিকেলেতো আমার গর্ভের সন্তানসহ তিন বছরের নূরকে এতিম করে সে চলেই গেলো। আর কয়েকদিনের মধ্যেই আমার গর্ভের সন্তান পৃথিবীতে আসার কথা। সেতো বাবার স্পর্শটুকুও পাবে না। আমার বাবার বাড়ি কিংবা আমার শ্বশুরবাড়ি সবারই অভাবের সংসার। সামনে সন্তান জন্মদান কিংবা আমাদের বেঁচে থাকার খরচ কীভাবে জুটবে তা ভেবে কোনো সমাধান পাই না। পরিবারে এক মেয়ে থাকতেই আমার স্বামী বলতো, দোকানের চাকুরির পাশাপাশি নতুন কিছু করবো। কিন্তু সে আমারে দুই সন্তান আর তার নতুন কবর উপহার দিয়ে গেলো।’
সুজনের মা দুলিয়া বেগম বলেন, ‘৬ তারিখ বিকালে হাসপাতালে বইয়া আমার বাবায় পানি চাইছিলো। হাতে গ্লাস ধইরা নিজেই খাইছে। নিজেই কইছে, আমি আর বাঁচবো না। খালি জিগাইছে- মা, আর রক্ত দেবে না? কইছি বাবা, দুই ব্যাগ দেওয়া অইছে, আরও দুই ব্যাগ আনা অইছে, এহনই দেবে। কিন্তু হেই দুই ব্যাগ দেওয়ার আগেই বাবায় আমার কোল খালি কইরা চইলা গেছে। বাবায় গ্রামের বাড়ি যাইয়া কিছু একটা করতে চাইতো। এহন আজীবনের লইগ্গা বাড়ির সামনে ঘুমাইতে আইছে।’
সুজনের মেডিকেল প্রতিবেদনে হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। বিস্তারিত বিবরণে বাম পাঁজরে টু সাইকেল ইনজুরি বা এপাশ-ওপাশ বৃত্তাকার একটি ছিদ্রের কথা উল্লেখ আছে। এছাড়া বড়ভাই রুবেল খান বলেন, ‘বাড়িতে দাফনের আগে আমরা সুজনের শরীরে গুণে গুণে ১১০টা ছররা গুলির চিহ্ন পেয়েছি। এছাড়া একটা বড় গুলি এপাশ-ওপাশ ছিদ্র করেছিলো ওর শরীর।’
রুবেল খান আরও বলেন, ‘ঘটনার এক মাস আগে আমি ঢাকা থেকে বেড়িয়ে আসি। ওর মৃত্যুর ৭-৮ দিন আগেও ফোনে বলছে, ভাই, আমি কিছু টাকা দিমু, তুমিও কিছু দিবা। দুইজন মিল্লা একটা মাহিন্দ্রা কিনমু। গ্রামে আইয়া ওইডা ভাগে চালাইয়া সংসার চালামু।’
সুজনকে দাফন করা হয় ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলা চেচরীরামপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ চেচরী গ্রামের নিজবাড়ির প্রবেশমুখে। তার পরিবার এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে দুই লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা পেয়েছে।
এর বাইরে বাকেরগঞ্জে বিএনপির এক নেতার কাছ থেকে ৫০ হাজার, জেলা প্রশাসন ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছে।
এদিকে ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক আশরাফুর রহমান জানিয়েছেন, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকার চেক সুজনের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এর মধ্য থেকে সুজনের স্ত্রী পাবে সাড়ে তিন লাখ টাকা এবং সুজনের বাবা-মা পাবে দেড় লাখ টাকা।