শিরোনাম
প্রতিবেদন : আল-আমিন শাহরিয়ার
ভোলা, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : ষোল বছরের কিশোর মো. সিয়াম। এখনো ছেলে বেলার দুষ্টমি যায়নি তার। এ বয়সে বিদ্যালয়ের সহপাঠী ও বন্ধুদের সঙ্গে খেলার মাঠে থাকার কথা। কিন্তু তাকে হাল ধরতে হয়েছে পুরো একটি পরিবারের।
ছোট বেলা থেকেই চঞ্চল সিয়াম কখনও কি ভেবেছে এ বয়সেই সংসারের খরচ যোগাতে বাবার ব্যবসার হাল ধরতে হবে তাকে? কিন্তু বাস্তবতা হলো তাকে তাই করতে হচ্ছে।
ভোলা শহরে ছাতা মেরামতের কাজ করা ছাত্র আন্দোলনে নিহত মো. জসিম উদ্দিনের (৫৫) একমাত্র ছেলে মো. সিয়ামের এমন দু:খ-দুর্দশার কথা এখন সবারই জানা। গত ৪ আগস্ট ভোলার নতুন বাজারে পুলিশ ও ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন জসিম।
তিনি ভোলা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পৌর নবীপুর এলাকার মৃত আবু কালাম খলিফার ছেলে। তার এক ছেলে দুই মেয়ে। বড় ছেলে সিয়াম ভোলা দারুল হাদিস কামিল মাদ্রসায় দশম শ্রেণিতে পড়ে। ১৩ বছর বয়সী বড় মেয়ে মিম একই মাদ্রসায় অষ্টম শ্রেণি ও ৮বছর বয়সী ছোট মেয়ে মুনতাহা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
জসিম উদ্দিন ভোলা শহরের নতুন বাজার ফুটপাতে ছাতা মেরামতের কাজ করে পরিবার চালাতেন। বাবা মারা যাওয়ায় ওই দোকানে কাজ করে সংসারের খরচ জোগান একমাত্র ছেলে সিয়াম।
জেলা সদর ভোলার নতুন বাজারে শহিদ জসিম উদ্দিনের দোকানে গিয়ে দেখা যায় ছেলে সিয়াম ছাতা মেরামত করছেন। এ সময় তার সঙ্গে কথা বললে সে জানায়, তাদের সংসার চালানোর আর কোনো উপায় নেই। তাই পড়ালেখার ফাঁকে বাবা’র রেখে যাওয়া দোকানে বসে কাজ করেন তিনি। এ দিয়ে যা আয় হয় তা দিয়েই মা ও দুই বোন নিয়ে চলে তাদের সংসার।
সিয়াম জানায়, বর্ষার সময় দোকানে কাজ থাকলেও এখন তেমন একটা কাজ নেই। তারপরও প্রতিদিন দোকান খুলে বসেন কিছু আয়ের আশায়। বাসায় বসে কি করবেন তাই কাজ না থাকলেও দোকানে আসেন, বসে থাকেন।
বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই চোখে পানি চলে আসে সিয়ামের। সিয়াম জানান, বাবার দোকান থাকা সত্ত্বেও সে কখনো এ কাজ করেনি। বাবা মারা যাওয়ায় সংসারের খরচ জোগাতে এখন সে বাধ্য হচ্ছে।
সিয়াম বলেন, ‘বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কখনো চকলেট, চিপস কিম্বা কখনো ঝালমুড়ি কিনে খেতাম। আজ বাবা বেঁচে নেই। তাই এখন আমাকে আর কেউ চিপস, চকলেট কেনার টাকা দেয় না। বরং পড়ালেখার পাশাপাশি সংসার চালানোর খরচ এখন আমাকেই জোগাতে হয়।’
স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, গত ৪ আগস্ট সকাল থেকেই চারদিক থেকেই ভোলা শহরে মিছিল নিয়ে প্রবেশ করে ছাত্র-জনতা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় তাদের। সংঘর্ষের সময় জসিম দোকান বন্ধ করে নতুন বাজার জিন্না মিয়ার মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় একটি গুলি এসে জসিম উদ্দিনের মাথায় লাগলে তিনি মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন। পরে সেখানে থাকা লোকজন তাকে উদ্ধার করে খলিফাপট্টি মসজিদের কাছে নিয়ে গেলে তিনি মারা যান। গুলিটি জসিম উদ্দিনের চোখের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে একটি দোকানের সাটার ছিদ্র করে দোকানে ঢুকে যায়। এর পর আর কি হয়েছে তারা বলতে পারেন না।
জসিম উদ্দিনের ছোট ভাই মো. সবুজ জানান, তারা দুপুরের পর খবর পেয়ে শহরের খলিফাপট্টি মসজিদের সামনে থেকে লাশ উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে দাফন করেন।
সবুজ আরো জানান, তারা লাশ বাড়িতে নিয়ে দাফন করার সময় দেখতে পান ভাইয়ের চোখের মধ্য দিয়ে একটি
গুলি প্রবেশ করে মাথা ছিদ্র করে কানের পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। এতে মাথার মগজও বের হয়ে যায়।
নতুন বাজারের শত শত মানুষ মৃত্যুর এ দৃশ্য দেখেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সবুজ জানান, তার ভাই ছাতা মেরামত করে সংসার চালাতেন। তার স্ত্রী ও তিনটি ছোট ছোট সন্তান রয়েছে। মা বিবি ফাতেমার বয়স ৭০ বছর। তিনি জসিম উদ্দিনের কাছে থাকতেন। ভাই মারা যাওয়ায় এখন সবুজের কাছে আছেন। তাদের মা অনেক অসুস্থ। প্রতি মাসে অনেক ঔষধ কিনতে হয়। কিন্তু টাকার অভাবে সেটিও কিনতে পারছেন না। এ দিকে জসিম উদ্দিন মারা যাওয়ায় তার সংসার চলে অনেক কষ্টে। তাই তিনি ভাই জসিম উদ্দিনের হত্যার বিচারের পাশাপাশি তার পরিবার যাতে ভালোভাবে চলতে পারে তার জন্য কিছু করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
শহিদ জসিম উদ্দিনের স্ত্রী নার্সিস বেগম জানান,তাদের পরিবারের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। তারা দুইলাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থা দুইলাখ, জেলা বিএনপি পঞ্চাশ হাজার এবং জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।
ভোলার জেলা প্রশাসক মো: আজাদ জাহান বলেছেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে শহিদদের তালিকা সম্পূর্ণ প্রণয়নের পর সরকার তাদেরকে যথাযথ সহযোগিতা করবে।