বাসস
  ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:২৯
আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৪১

বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের স্বপ্ন বুকে নিয়ে আন্দোলনে যেতেন অকুতোভয় শহিদ উসামা

প্রতিবেদন : আব্দুর রাজ্জাক 

কুষ্টিয়া, ২৮ জানুয়ারি, ২০২৫( বাসস) : কৃষক বাবার ছোট ছেলে হাফেজ মোহাম্মদ উসামা। তাঁর ইচ্ছা ছিল বড় আলেম হয়ে ইসলামের বাণী চারদিকে প্রচার করবেন। কিন্তু এ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়ার আর সুযোগ পেল না। পুলিশের ছোঁড়া বুলেটে তছনছ হয়ে গেলো সব। 

গণমানুষের অধিকারের আদায়ের লক্ষ্যে গেল বছরের জুলাইয়ে শুরু হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন। 

সবশেষে তা রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য এবং বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে মোহাম্মদ উসামা আন্দোলনে সক্রিয় হন। তার নেতৃত্বে ছাত্র জনতার একাংশ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে।

কিন্তু গত পাঁচ আগস্ট বিজয়ের মুহুর্তে বুলেটের কাছে হার মানেন উসামা। তার গলা ও পিঠ দিয়ে বুলেট এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। রাজপথে তাজা রক্ত দিয়ে উসামার মতো আরো অনেকে তৈরি করেছেন নতুন ইতিহাস। আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন ফ্যাসিস্টমুক্ত নতুন বাংলাদেশ।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আলমপুরের শিমুল গ্রামের কৃষক জয়নাল আবেদীন (৫০) ও গৃহিণী রাবেয়া খাতুন(৪৫) এর ছোট ছেলে মোহাম্মদ উসামা (১৭)। কৃষক হলেও জয়নাল আবেদীন সম্ভ্রান্ত মুসলিম ও ধর্মভীরু। বড় মেয়ে সুমাইয়া,(২৩) মেজ ছেলে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মাহমুদুল হাসান (২১) ও ছোট ছেলে মোহাম্মদ উসামা কে নিয়ে ছিল তার সুখের সংসার। জয়নাল আবেদীনের তিন ছেলে মেয়ে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত। এর মধ্যে শহিদ উসামা ১৫ পাড়া কুরআনের হাফেজি শেষ করে কোয়াতুল ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসায় অধ্যায়নরত ছিলেন।

 

প্রত্যক্ষদর্শী ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, জুলাই এর ১৭ তারিখ থেকে সকল বাধা ও প্রতিবন্ধকতা পায়ে মাড়িয়ে আন্দোলনে সরব ছিলেন উসামা। প্রশাসনের গ্রেফতারের ভয় থাকলেও ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে অদম্য সাহস নিয়ে আন্দোলনের অগ্রভাগেই অবস্থান নেন তিনি। এভাবেই চলছিল প্রতিদিন। গত পাঁচ আগস্টও উসামা কুষ্টিয়ার পাঁচ রাস্তার মোড়ে শক্ত ও দৃঢ় অবস্থান নেন। ঐ দিন সকাল থেকেই বৃষ্টির মধ্যেই ছাত্র জনতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন উসামা। এদিকে পুলিশ এলোপাথাড়ি ভাবে গুলি, টিয়ার শেল আর সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়তে থাকে। অভ্যুত্থানে মৃত্যুর ভয়কে জয় করে অনড় অবস্থানে থাকেন উসামা। দুপুরের পর স্বৈরশাসক হাসিনার পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরও থানা পুলিশের অমানবিক আচরণ আর গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়নি। একপর্যায়ে উসামাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে পুলিশ। রক্তাক্ত হয়েও অবস্থান ত্যাগ করেননি তিনি। পরে রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়েন। আন্দোলনে অংশ নেওয়া অন্য সহযোদ্ধারা উসামাকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। 

উসামা দেশের জন্য শহিদ হয়েছে এবং সে আমাদের গর্ব এমন মন্তব্য করে তার বড় ভাই মাহমুদুল হাসান বাসসকে বলেন, আমার ভাই দেশের মানুষের জন্য আন্দোলন করেছে। সে শহিদ হয়েছে। ভাই হারানোর বেদনা খুব যন্ত্রণাদায়ক, তারপরও আমরা গর্ব করি। 

তিনি বলেন, ৫ আগস্ট দুপুরের পরে আমি আমার ভাইকে ফোন করি, কিন্তু সে ফোন রিসিভ করছিল না। পরে তিনটার দিকে আবার ফোন দেই। তখন অপরিচিত একজন ব্যক্তি ফোন রিসিভ করে জানান আমার ভাই গুলিতে মারা গেছে। 

অশ্রুসিক্ত নয়নে মা রাবিয়া খাতুন বাসসকে বলেন, ‘আমার ছেলে দেশের জন্য শহিদ হয়েছে। আমরা কারো নামে কোন মামলা, অভিযোগ করিনি। আমার ছেলেকে আল্লাহ শহিদ হিসেবে কবুল করুক।’ 

কান্না জড়িত কন্ঠে শহিদ উসামার পিতা জয়নাল আবেদীন বাসসকে বলেন, ‘আমার ছেলে বড় হয়ে আলেম হতে চেয়েছিল। কিন্তু সে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দেশের জন্য শহিদ হয়েছে। আমার তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে সব থেকে ছোট উসামা। সে দেশের জন্যে নিজের জীবন দিল।

সাহায্য সহযোগিতা পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে  কিছু সাহায্য পাওয়ার কথা জানান।

স্বজন ও প্রতিবেশীরা জানান, উসামা খুব ভালো ছেলে ছিল। অনেক সুন্দর কোরআন তেলাওয়াত করত। 

জুলাইয়ের ১৭ তারিখ থেকে সে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। দেশ নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল তার।

এদিকে ছোট ছেলেকে হারিয়ে পুরো পরিবার মুষড়ে পড়েছে বলেও তারা জানান।