বাসস
  ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৩৫
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১৯

‘এরা কী মানুষ, না জানোয়ার’? এ প্রশ্ন শহিদ সাইফুলের স্ত্রী রহিমার

শহিদ সাইফুল ইসলাম - ছবি : বাসস

মো. আব্দুল কাইয়ুম

ময়মনসিংহ , ২৯ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : গত ২০ জুলাই দুপুরে ময়মনসিংহের ফুলপুরে ধান বিক্রি করতে গিয়েছিলেন কৃষক সাইফুল ইসলাম। সংসারের অভাবের চাপে কুঁকড়ে যাওয়া জীবনে ছেলে মেয়ের জন্যে ভালোমন্দ খাবারের যোগাড় সবসময় করতে পারেন না। তাই মেয়ের আব্দার মেটাতে তিনি আম কেনার জন্যে বাজারে গিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়ের আম খাওয়ার ইচ্ছে আর পূরণ হলো না। তার বাবা ফিরলেন লাশ হয়ে। 

একটি বুলেট লণ্ডভণ্ড করে দিল সব। চিরদিনের জন্যে পাল্টে গেলো সাইফুলের পরিবারের পুরো চালচিত্র।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশের গুলিতে শহিদ হলেন সাইফুল ইসলাম (৩৫)। তার মৃত্যু কেবল একটি প্রাণের অবসান নয়, এটি একটি পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ এবং তিন নিষ্পাপ শিশুর ভবিষ্যৎ চুরমার করে দেয়া।

সাইফুলের বিধবা স্ত্রী রহিমা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না করতে করতে বলেন, ‘উনিতো ধান বেচতে গেছিলেন, কেন তারে গুলি করে মারলো? উনি বেঁচে থাকতেইতো দিন চলতো কষ্টে। এখন আমি তিনটা শিশু ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাঁচবো কীভাবে?’ 

সাইফুলের বড় মেয়ে মিম (৬) প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। মেজো ছেলে রামিম (৪) আর ছোট মেয়ে সায়মা (২)। এখনও তারা বুঝতে পারে না তাদের বাবা আর কখনো ফিরে আসবে না।

প্রতি রাতে ছোট মেয়ে সায়মা বাবার জন্য চিৎকার করে, মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আম্মা, আব্বা কই? কবে আইবো?’ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে রহিমা বোবা হয়ে যান।

সেদিন সাইফুলেরা দুই ভাই মিলে ধান বিক্রি করতে গিয়েছিলেন। ৭৮ মণ ৫ কেজি ধান বিক্রির পর সাইফুল মেয়ের জন্য আম কিনতে ফলের দোকানের দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু কয়েক গজ দূর যেতেই গুলির শব্দে বাজার এলোমেলো হয়ে যায়। ছোট ভাই শহিদুল দৌড়ে গিয়ে দেখেন, গুলিতে বিদ্ধ সাইফুল রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। গুলিটি তার বাম চোখের ভ্রু ভেদ করে ডান কানের নিচ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।

পরে দ্রুত চিকিৎসার জন্য সাইফুলকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি মারা যান। শহিদুলের প্রশ্ন, ‘শুনেছি পুলিশ নাকি হাঁটুর নিচে গুলি করে।

তাহলে মাথায় গুলি করলো কেন?’ কিন্তু এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।

সাইফুলের মৃত্যু শুধু তার স্ত্রী আর সন্তানদের নয়, পুরো পরিবারের জন্য এক চরম ধাক্কা হয়ে এসেছে। সাইফুলের বাবা তৈয়ব আলী ছেলের মৃত্যুর পর থেকে নির্বাক। ঘর থেকে বের হন না, কারও সঙ্গে কথাও বলেন না। আর তার দাদা আফতাব উদ্দিন নাতির লাশ দেখে জ্ঞান হারান। তিনদিনের মধ্যেই তিনিও মারা যান। একে একে দুই প্রিয়জনের লাশ কাঁধে নিয়ে দাফন করেন কৃষক তৈয়ব আলী।

এদিকে রহিমার জীবনে নেমে এসেছে  ঘোর অন্ধকার। তিনি বলেন, ‘স্বামী নিহত হওয়ার পর থেকে একদিনও ভালো কিছু বাচ্চাদের মুখে তুলে দিতে পারিনি। আজও  শুধু ডাল-ভাত খেয়েছে।’ 

রহিমার প্রশ্ন, ‘একটা মায়ের বুক খালি করার জন্য কেউ কী এভাবে মানুষকে গুলি করে মারে? এরা কী মানুষ, না জানোয়ার?’