বাসস
  ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৪৫

‘ঔষধের টাকা যোগাড় করতে গেলে খাবারের টাকায় টান পড়ে, আমাদের কিভাবে চলবে?’ এ প্রশ্ন শহিদ রানার বাবা মায়ের

শহিদ তৌহিদুর রহমান রানা - ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : রুপোকুর রহমান

সাভার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : বাবা মায়ের আদরের ছোট ছেলে তৌহিদুর রহমান রানা। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বুলেটের আঘাতে শহিদ হন তিনি। তাকে হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তার বৃদ্ধ বাবা-মা। অসহায় হয়ে পড়েছে স্ত্রী ও দুই বছরের শিশু সন্তান। টগবগে যুবক তৌহিদুরের অকালে চলে যাওয়া কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না বৃদ্ধ বাবা-মা। মৃত্যুর ছয়মাস পরও সন্তানের স্মৃতি তাড়া করে ফিরছে তাদের।

তৌহিদুর রহমান রানার বাবা আব্দুল জব্বার মোল্লা (৬১) এবং মা রশিদা খাতুন (৫১)। জাহিদ হাসান (৩৪) নামের এক বড় ভাই রয়েছে তার। গ্রামের বাড়ী যশোরের কেশবপুর উপজেলার ১০ নং সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের ভালুকঘর গ্রামে। বৃদ্ধ বাবা-মা’কে বাড়িতে রেখেই ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে অর্থ উপার্জনের আশায় ২০১৯ সালে সাভারের আশুলিয়ায় চলে আসেন তৌহিদুর রহমান রানা (২৮)। সেখানে ক্রয়ডন-কাউলুন ডিজাইনস লিমিটেড কারখানায় ফিনিশিং সেকশনে কাজে যোগ দেন। বছর তিনেক আগে কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার বাসিন্দা নাসরিন আক্তার সাথীকে বিয়ে করেন। স্ত্রী নাসরিন আক্তার সাথীকে নিয়ে সাভারের আশুলিয়ার বাইপাইল কাইচাবাড়ী এলাকায় বসবাস করতেন তৌহিদুর রহমান রানা। আয়শা আক্তার নামের তাদের সংসারে দুই বছরের একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে।

শহিদ তৌহিদুর রহমানের দাদা মৃত কাদের মোল্লা এবং দাদী মৃত রিজিয়া বেগম। নানার নাম মৃত আব্দুর রহিম মোড়ল এবং নানীর নাম মৃত নুরজাহান বিবি।

গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায় হলে সকলের সাথে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন তৌহিদুর রহমান রানাও। অন্যদের সাথে বিজয় মিছিলে যোগ দেন তিনি। 

বিজয় মিছিল নিয়ে আশুলিয়া থানার দিকে যাওয়ার সময় প্রেসক্লাবের সামনে পিঠের বাঁপাশে গুলিবিদ্ধ হন রানা। 

সন্ধ্যা ৬টার দিকে রানাকে মোবাইল ফোনে না পেয়ে দুঃশ্চিন্তা বাড়ে বড় ভাই জাহিদ হাসানের। পরে মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতাল থেকে রানার মৃতদেহ শনাক্ত করেন তিনি।

শহিদ রানার বাবা আব্দুল জব্বার মোল্লা বাসস’কে মুঠোফোনে বলেন, ‘আমরা সবাই নামাজ-রোজা করি। আমার ছেলেরাও একই রকম হয়েছে। কোন অন্যায় কাজে তারা জড়িত ছিল না। আমরা বৃদ্ধ হয়েছি। আমাদের ছোট ছেলেটাকে ওরা গুলি করে মেরে ফেলেছে। এ খবরে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমাদের এখন কিভাবে চলবে? বৃদ্ধ বয়সে আমরা কোন কাজ করতে পারি না। এক ছেলের উপার্জনেই আমাদের চলতে হচ্ছে। ঔষধের টাকা যোগাড় করতে গেলে খাবারের টাকায় টান পড়ে । এ অবস্থায় খুব কষ্টে দিন যাপন করছি।’

ছেলে হত্যার বিচার দাবি করে তিনি বলেন, আমাদের যারা সন্তানহারা করলো, আমার নাতনিকে যারা এতিম করলো আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। 

শহিদ তৌহিদুর রহমান রানার মা রশিদা খাতুন বাসস’কে মুঠোফোনে বলেন, আমার ছেলে রানা ছিল অনেক সাংসারিক। পরিবারের কথা চিন্তা করে ও সাভারে গিয়ে গার্মেন্টস-এ কাজ নেয়। ভালোই চলছিল আমদের। কিন্তু হঠাৎ ওর মৃত্যু আমাদের সবকিছু এলোমেলো করে দিলো। আমি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। কোমরের হাড় ক্ষয় হয়ে গেছে। ঠিক মতো চলতে ফিরতে পারি না। মাসে হাজার হাজার টাকার ঔষধ লাগে। বড় ছেলেই এখন সব কিছু দেখাশোনা করছে। ও আর কতো বেতন পায়। যা পায় বেশীর ভাগই আমাদের পেছনে ব্যয় করে। ওর তো সংসার আছে। পরিবার আছে। এভাবে কি আর চলে? 

নিজেদের পাশাপাশি ছোট ছেলে তৌহিদুর রহমান রানার একমাত্র শিশু কন্যা নাতনি আয়শার ভবিষ্যতের জন্য একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানান তিনি।

রানার বড় ভাই জাহিদ হাসান বাসস’কে  মুঠোফোনে বলেন, ‘আমার ছোট ভাই তৌহিদুর রহমান রানা ছিল অনেক ভালো। কোনদিন আমাদের অবাধ্য হয়নি। ২০১৯ সালে এসে আশুলিয়ার কাইচাবাড়ী এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজে যোগ দেয়। পরে আমিই তাকে বিয়ে করাই। ওর একটি দুই বছরের মেয়ে সন্তানও রয়েছে। 

জাহিদ হাসান আরো বলেন, গত ৫ আগস্ট বিকেলে আমার কাছে আসার কথা ছিল আমার ভাই তৌহিদের। কিন্তু সন্ধ্যা পার হলেও ও না আসায় আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি। তখন আমি ওর মোবাইলে ফোন দিলে অপর প্রান্ত থেকে এক নারী রিসিভ করে বলেন, এই ফোনের মালিক গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমরা একসাথেই ছিলাম। আমিও গুলিবিদ্ধ হয়েছি। মোবাইল ফোনটি এখন আমার কাছে আছে। আমি আছি আশুলিয়ার নারী ও শিশু কেন্দ্র হাসপাতালে। আপনি এসে মোবাইল ফোন নিয়ে যান। তখন আমি গিয়ে হাসপাতাল থেকে আমার ভাইয়ের মোবাইল ফোনটি নেই। পরে আমি আমার ভাইয়ের সন্ধান চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লাইভ করলে কেউ একজন এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকা দুটি লাশের ছবি পাঠায়। সেখানে আমি আমার ভাইয়ের মৃতদেহ দেখতে পাই। পরদিন ৬ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতাল থেকে আমার ভাই তৌহিদুর রহমানের মৃতদেহ গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাই। গ্রামের বাড়িতেই আমার ভাইয়ের মরদেহ দাফন করা হয়।

শহিদ তৌহিদুর রহমানের পরিবারকে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ৫ লাখ টাকা, জুলাই স্মৃতি  ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা এবং আওয়াজ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে। এদিকে তৌহিদুর রহমান রানা হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।