বাসস
  ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:২৪

সন্তানদের উৎসুক চোখ খোঁজে কেবল বাবাকেই

শহিদ মো.আব্দুল জব্বার- ছবি : বাসস

প্রতিবেদন: বরুন কুমার দাশ

ঢাকা, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : বাবা শহিদ হওয়ার পর থেকে ছেলে মেয়ে দুটি কিছু খেতে চায় না। কথাও বলে না ঠিকমতো। সব সময় মন খারাপ করে থাকে। মাঝে মাঝে বাবার কথা মনে করে কাঁদতে শুরু করে। 

কথাগুলো বলছিলেন শহিদ মো.আব্দুল জব্বারের স্ত্রী সুমাইয়া ইসলাম সুমি (৩২)।

তিনি জানতে চান, আমার স্বামীর কী অপরাধ ছিল? আমাকে কেন বিধবা হতে হলো? আমার ছেলে-মেয়েকে কেন বাবা হারা হতে হল? 

তিনি তার স্বামী হত্যার বিচার দাবি করেন।

রাজধানীর মহাখালীতে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে ক্ষুদ্ধ সুমি একের পর এক প্রশ্ন করেন, আমাদের সুখের সংসারে এমন পরিস্থিতি কেন হলো?

সন্তানদের ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তা কে দেবে? আমার সংসার কিভাবে চলবে? আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো? কিভাবে চলবে আমার ও ছেলে-মেয়ের জীবন?

আব্দুল জব্বার তিতুমীর সরকারি কলেজ থেকে মাস্টার্স পাশ করেছেন। তিনি রাজধানীর মেরুলবাড্ডা এলাকায় এসিআই কোম্পানীতে সেলস ম্যানের চাকুরি করতেন। দুই সন্তান, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে ছিল তার সংসার। জব্বার গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় মেরুল বাড্ডার সিরাজ মিয়া স্কুলের সামনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। তাকে হারিয়ে এখন নিঃস্ব তার পরিবার।

কান্না থামছে না স্ত্রী, সন্তান ও তাঁর মায়ের। দুই শিশু সন্তানের উৎসুক চোখ এখন কেবল বাবাকেই খোঁজে। বাবার বয়সী কাউকে দেখলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তারা। এদিকে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন তাদের মা সুমি। 

জানা গেছে, আব্দুল জব্বারের (৪০) গ্রামের বাড়ি নোয়াখালি সদর উপজেলার মহব্বতপুর গ্রামে। তাঁর পিতা মৃত আব্দুল মতিন এবং মা নাজমা বেগম (৭১)। জব্বার এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক ছিলেন। ছেলে সামি ইসলামের বয়স ১২ এবং মেয়ে নুজাইফা ইসলামের বয়স (৪) বছর। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন আব্দুল জব্বার। 

গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যা ৭ টার দিকে রাজধানীর মেরুল বাড্ডার সিরাজ মিয়া স্কুলের সামনে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন আব্দুল জব্বার।  তিনি মেরুল বাড্ডা এলকার বাসিন্দা ছিলেন। পরে ৬ আগস্ট বাদ আসর মহাখালিস্থ রহিম মেটাল কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। 

সুমাইয়া ইসলাম সুমি বলেন, বাচ্চাগুলো সব সময় মন খারাপ করে থাকে। কিছু খেতে চায় না, বাবার কথা মনে হলেই কান্না শুরু করে। ওর বাবা যে আর ফিরবে না, আল্লাহর দরবারে চলে গেছে, সেটা কোন ভাবেই তারা বুঝতে চায় না।  কি করবো ওদের নিয়ে, জানি না। আসলে ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে আমি অনেক বেশি চিন্তিত। 

তিনি বলেন, ওদের বাবা ছোট একটা চাকুরি করতেন। যা বেতন পেয়েছেন, তা দিয়ে কোনরকমে সংসার চালাতেন। সঞ্চয় করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে বাসা ভাড়া, বাজার খরচ, ছেলের লেখাপড়ার খরচ। কত টাকা লাগে তাতো সবার জানা। 

তিনি বলেন, আমার শাশুড়ি অসুস্থ মানুষ। তার জন্য ওষুধ কিনতে হয়। আগামী বছর মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে, কিন্তু স্কুলের বেতন কি ভাবে পরিশোধ করবো?

বাসা ভাড়া কি ভাবে দেব? বাজার খরচ কি ভাবে চলবে? জব্বারের আয়েই চলতো আমাদের সংসার। আমি কোন উপায় না পেয়ে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেছি। কিন্তু এতে আর কয় টাকা আয় হবে? এই টাকা দিয়ে তো আর সংসার চলবে না। কি ভাবে যে কি হবে আল্লাহ জানেন। 

শহিদ আব্দুল জব্বারের বড় ভাই রাশেদ খান বলেন, আমার ভাই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন। তার এক ছেলে, এক মেয়ে রয়েছে। তাকে হারিয়ে পরিবার এখন দিশেহারা। কিভাবে তাদের সংসার চলবে এই চিন্তায় চোখে অন্ধকার দেখছে তারা। আমিও ছোট একটা চাকুরি করি। আমি তো চাইলেই সব সময় সহযোগিতা করতে পারবো না। 

তিনি বলেন, আসলে সেদিনের অবস্থা ও কষ্টের কথা বলে বুঝানো যাবে না। ছোট ভাইটার ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী ও মা সব সময় মন খারাপ করে থাকে। ভাতিজা-ভাতিজি’র মুখের দিকে তাকাতে পারি না। ছোট ছেলেটাকে হারিয়ে আম্মাও সব সময় কান্নাকাটি করেন। আর কোন পরিবারকে যেন এমন সমস্যায় পড়তে না হয় আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি। 

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে শহিদ জব্বারের স্ত্রী সুমি বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেন। শেখ হাসিনা’র পালানোর খবর শুনে বিকেলে আমার স্বামী বিজয় মিছিলে যায়। পরে বিকেল ৫ টার দিকে বাসায় ফিরে ছেলে-মেয়ের সাথে নাস্তা খেয়ে মাগরিবের নামাজ পড়তে বের হন।

এর পরে তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। ফোন বন্ধ পাচ্ছিলাম। রাত ১২ টা বেজে যায় খবর পাই না। তখন সবাই মিলে তাকে খুঁজতে বের হই। পরে বাসার নিচের একজন বলেন, ‘জব্বার ভাইয়ের শরীরে গুলি লাগছে সন্ধ্যা ৭ টার দিকে। তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেছে।’ পরে আমরা ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে অনেক খোঁজাখুজি করি।

শেষপর্যন্ত পাই তার লাশ। জব্বারের পেটে গুলি লেগেছিল। পরে ঢাকা মেডিকেল থেকে লাশ নিয়ে আসি এবং ৬ আগস্ট বাদ মাগরিব জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।

শহিদ জব্বারের বড় ভাই রাশেদ খান বলেন, যারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের সবাইকে শহিদের মর্যাদা দিতে হবে। ভবিষ্যতে আর কোন স্বৈরাচার যাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে না পারে এমন ব্যবস্থা করতে হবে। আর যেন হাজার হাজার মায়ের বুক খালি না হয়। যারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে।

একই সাথে এই আন্দোলনে সারাদেশের যে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়েছে তাদের পুনর্বাসন করার দাবি জানান রাশেদ খান। 

কারো কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে জব্বারের স্ত্রী বলেন, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। পাঁচ লাখ টাকা দ্রুতই দেবে বলে জানিয়েছে। এছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছি।