বাসস
  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩:৩১

আমার ছেলেটা চোখের সামনেই মারা গেল, কিছুই করতে পারলাম না, শহিদ সিফাতের পিতা

শহিদ মো. সিফাত হোসেন -ছবি : বাসস

প্রতিবেদন: বরুন কুমার দাশ

ঢাকা, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন সিফাত। পরিবারের অর্থনৈতিক অভাবের কারণে আর বেশিদূর পড়তে পারেনি তিনি। ভবিষ্যতে চাকরি করার কোনো ইচ্ছা বা পরিকল্পনা ছিল না তাঁর। কিন্তু তবুও শহিদ আবু সাঈদের রক্তের ঋণ শোধ করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সিফাত ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি কোটা সংস্কারের পক্ষে, রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে। 

সেদিন ছিল ২০ জুলাই। ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন দুপুর ১টা। কারফিউ চলাকালীন মিরপুর-১০ নম্বরের ২৫২ নম্বর মেট্রোরেলের পিলারের পাশে নির্মাণাধীন একটি ভবনের চতুর্থ তলায় অবস্থান করছিলেন সিফাত। সাথে ছিলেন তার অপর এক বন্ধু সিয়াম ও সিফাতের বাবা কামাল হাওলাদার। চতুর্থ তলা থেকে নিচে সিফাত দেখতে পায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে একটা মিছিল বের হয়। সাঁজোয়া যানে ওঁতপেতে থাকা ঘাতক পুলিশ সেই শিক্ষার্থীদের মিছিলে পাকহানাদার বাহিনীর মতো অতর্কিত গুলিবর্ষণ শুরু করে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহিদ মো. সিফাত হোসেন -ছবি : বাসস 

নারকীয় গণহত্যার সম্পূর্ণ এই ভিডিও সিফাত তার মোবাইলে ধারণ করে। নিচে থাকা ঘাতক পুলিশ তাদের নারকীয় গুলিবর্ষণের দৃশ্যধারণ করা দেখে ফেলে। তারা সিফাত ও তার বন্ধু সিয়ামকে লক্ষ্য করে নিচ থেকেই গুলি করতে শুরু করে। ঘাতকের একটি বুলেট এসে সিফাতের মাথা ভেদ করে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। অন্য আরেকটি বুলেট এসে সিফাতের বন্ধু সিয়ামের চোখের মণি ভেদ করে মাথার মধ্যে ঢুকে যায়।

গুলি লাগর পর সিফাত ‘আব্বু’ বলে শেষ চিৎকার দিয়ে মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়ে ফ্লোরে। অপর রুম থেকে ওর বাবা এসে দেখেন, সন্তানের নিথর দেহ পড়ে আছে। পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সিফাতের মগজ। মাথা গড়িয়ে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছিল সিফাতের শরীরের তাজা রক্তে। 

রাজধানীর মিরপুরে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদ মো. সিফাত হোসেনের বাবা কামাল হাওলাদার এসব কথা জানান।

তিনি বলেন, ছেলে আমার ইতালি যাওয়ার ভিসা পেয়েছিল। গেল বছরের ২৫ জুলাই তার ইতালি যাওয়ার কথা ছিল। বিমান টিকিটও কাটা ছিল। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। ইতালি যাওয়ার আগেই ২০ জুলাই আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে সবাইকে ছেড়ে চলে গেলো সে। আমার ছেলের ইচ্ছা ছিল বৈষম্যহীন একটি সমাজ গঠন। যেখানে সবার অধিকার থাকবে সমান।

সিফাতের (২৬) গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর জেলার কালকিনী উপজেলার রমজানপুর ইউনিয়নের চড়পালরদি গ্রামে। বাবা কামাল হাওলাদার (৫১) ও মা পারভিন বেগম (৪২)। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সিফাত ছিলেন সবার বড়। সিফাতের ছোট ভাই রিফাত হোসেন (১৮) এবং ছোট বোন জান্নাত (১২)। ভাই রিফাত এই বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন।

বোন মিরপুরের মনিপুর স্কুলে পড়লেও, সিফাত নিহত হওয়ার পর তারা এখন গ্রামের বাড়িতে থাকেন এবং স্থানীয় একটি স্কুলে লেখা পড়া করছে জান্নাত। 

সিফাত হোসেন ২০ জুলাই মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। পরে সেই দিন রাতে ১০ টার দিকে গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে সিফাতকে দাফন করা হয়।  

শহিদ সিফাতের বাবা কামাল হাওলাদার বলেন, টাকার অভাবে আমি ওকে লেখাপড়া করাতে পারি নাই। 

সিফাতের স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। সেই স্বপ্নকে কাঁধে ভর করেই পাড়ি জমায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব। 

সিফাত সেই দেশে তিন বছর থেকে দেশে ফিরে আসে। পরে ঠিক করে ইউরোপের দেশ ইতালি যাবে। ইউরোপ পাড়ি দেওয়ার সব প্রক্রিয়াই শেষ হয়েছিল। ভিসাও পেয়েছিল সে। ২৫ জুলাই ইতালি যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু তা আর হলো না। 

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি বারবার আমার সন্তানদের আন্দোলনে যেতে নিষেধ করতাম। প্রথম দিকে ওরা তেমন একটা আন্দোলনে যেত না। কিন্তু রংপুরে আবু সাঈদ শহিদ হওয়ার পর তাদের আর ঘরে আটকে রাখতে পারিনি। ২০ জুলাই দুপুর ১টার দিকে মিরপুর-১০ নম্বরের ২৫২ নম্বর মেট্রোরেলের পিলারের পাশে নির্মাণাধীন একটি ভবনের চতুর্থ তলায় অবস্থান করছিল সিফাত ও তার বন্ধু। আমি খবর পেয়ে সেখানে যাই, ছেলেকে আন্দোলন থেকে বাসায় ফিরিয়ে নিতে। আমি অনেক বুঝাই ওকে, বাসায় যেতে। সিফাত বলে ‘তুমি যাও আমি একটু পরে আসছি’।  এই বলে আমি যখন নিচে নামতে থাকি তখনই শুনতে পাই সিফাতের ‘আব্বু’ বলে চিৎকার। আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি সিফাত ফ্লোরে পড়ে আছে। পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মগজ। 
আমার সন্তানের রক্তে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছিল।  আমি সিফাত বলে চিৎকার করে ওকে জড়িয়ে ধরি। তখন সে কি যেন বলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমি ওর কথা বুঝতে পারি নাই।

আমার ছেলেটা চোখের সামনেই মারা গেল, কিছুই করতে পারলাম না। আমি যদি সিফাতকে সেই সময়ে জোর করে বাসায় নিয়ে যেতাম তাহলে ওকে জীবন দিতে হত না। বাবা হিসাবে আমি ব্যথর্, এই বলে তিনি কান্না করতে থাকেন।

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কামাল হাওলাদার বলেন, ওকে কয়েকজন মিলে বিল্ডিং থেকে নিচে নামাই। হাসপাতালে নেয়ার জন্যে কোন কিছু পাচ্ছিলাম না। তখন ওই এলাকায় পুলিশের সাথে সাধারণ জনতার গোলাগুলি চলছিল। পরে অনেক কষ্টে একটা রিকশায় করে সিফাতকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে হাসপাতাল থেকে সিফাতের লাশ নিয়ে মিরপুরে আসি। তখন রাস্তায় পুলিশ অনেক ঝামেলা করে। লাশ নিয়ে যেতে দেবে না। রাস্তায় লাশ রাখতে দেবে না। পরে কোন রকম ভাবে একটি গাড়ী ভাড়া করে সিফাতের লাশ গ্রামের বাড়ি কালকিনীতে নিয়ে যাই এবং রাত ১০ টার দিকে পারিবারিক কবরস্থানে  দাফন করি।

কামাল হাওলাদার বলেন, ‘এই সরকার আমাদের সন্তানদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে গঠিত হয়েছে। আমাদের সন্তানদের যারা হত্যা করেছে, তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি তাদের বিচার চাই। 

খুনি আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের বিচারের জন্য প্রয়োজনে আমিও আমার সন্তানের মতো আবারও জীবন দেব।’

সহযোগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে সিফাতের বাবা বলেন, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকার চেক পেয়েছি। এছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর মিরপুরে মো. সিফাত হোসেন নিহতের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মিরপুর মডেল থানায় শহিদ সিফাতের বাবা কামাল হাওলাদার বাদী হয়ে এই মামলা করেন।