শিরোনাম
প্রতিবেদন: মো.শফিকুল ইসলাম
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): তখনও কৈশোর কাল কামরুল মিয়ার। এই বয়সেই হাল ধরতে হয়েছিল পরিবারের। বাস্তবতা মেনে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করার সময় ২০১৬ সালে বাড়ি ছাড়েন তিনি। পাড়ি জমান স্বপ্নের শহর ঢাকায়।
রাজধানী শহরে দৈনিক মজুরি ভিত্তিক ফার্নিচার দোকানে শ্রমিক থেকে শুরু করে ভ্যান চালানোর কাজসহ সবই করতেন তিনি। স্বপ্ন ছিল জমানো টাকা দিয়ে প্রবাসে পাড়ি জমাবেন।
পরিবারের সুখের আশায় তাঁর এই স্বপ্ন। থাকতেন ঢাকার মিরপুর স্টেডিয়াম এলাকায়।
তবে পুলিশের গুলিতে কামরুলের এই স্বপ্নের আলো চিরতরে নিভে গেছে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকায় গুলিতে শহিদ হন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার গৌরনগর গ্রামের কামরুল মিয়া (২৪)। গত ১৯ জুলাই রাজধানী মিরপুর-১০ নম্বরের গোল চত্বরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন কামরুল মিয়া। আগের দিন শরীরে র্ছরা গুলি বিদ্ধ হলেও কামরুল মিয়া পিছপা হননি।
উপার্জনক্ষম কামরুলের পরিবার এখন অনিশ্চয়তার মুখে। সংসারে তারা আট ভাই-বোন। এদের মধ্যে কামরুল মিয়া ছিলেন তৃতীয়। মা শিরিনা বেগম ছয় বছর আগে মারা গেছেন। বোন জোসনা বেগম ও পাখি বেগমের বিয়ে হয়েছে। এখনও বিয়ে হয়নি ছোট বোন সাদিয়া ও ইসার। ছোট বোন ইসা স্থানীয় একটি মহিলা মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেনিতে লেখাপড়া করে। আরেক ভাই হামিম স্থানীয় গৌরনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেনিতে পড়ছে।
বৃদ্ধ বাবা নান্নু মিয়া (৬০) বাড়িতেই দিন কাটান। এক সময় কৃষিকাজ করলেও এখন বয়সের ভারে কিছু করতে পারেন না। বড় ভাই সেলিম মিয়া কোন কাজকর্ম করে না। আরেক ভাই হামিম বয়সে ছোট। এখন সংসার চলে স্বজনদের সহায়তায়। শহিদ কামরুলের এক ভাই মাছুম মিয়া চারবছর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ওই ভাইয়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে জমি বিক্রি করতে হয়। এখন সম্বল গ্রামের বসতভিটা।
এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়েছে, কামরুল হত্যায় ঢাকার মিরপুর থানায় একটি মামলা হয়েছে।
শহিদ কামরুলের বড় বোন জোসনা বেগম বলেন, ‘ছাত্র আন্দোলনে আমার ভাই কামরুল শহিদ হয়েছে। পুলিশ মারফত জানতে পেরেছি, এ হত্যার ঘটনায় মিরপুর থানায় একটি মামলা হয়েছে। আমরা ভাই হত্যার বিচার চাই।’
আরেক বোন পাখি বেগম জানান, ২১ জুলাই আমার ভাইয়ের লাশ নিয়ে আসা হয় আমাদের গ্রামের বাড়িতে। পরদিন ২২ জুলাই সকালে গৌরনগর কান্দাপাড়া ঈদগাহ মাঠে জানাযা শেষে কবরস্থানে দাফন করা হয়।
কামরুলের বড় ভাই সেলিম মিয়া বলেন, ‘আমরা গ্রামের মানুষ। তিনি আরও বলেন, আমাদের চার ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাই মারা গেছে। আমিও কিছু করি না। আরেকজন ছোট।
এখন সংসার চালাতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। বোন জামাইসহ আমাদের স্বজনদের সহায়তায় সংসার চালাতে হচ্ছে।’
ভাইয়ের লাশ আনতে গিয়ে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তা জানান সেলিম মিয়া। তিনি বলেন, কামরুল ১৯ জুলাই বিকেলে মারা গেলেও ২০ তারিখ আমরা খবর পাই। এরপর একাধিক মেডিকেলে ঘোরাঘুরি করি। এক দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমরা কামরুলের লাশ পাই।
এর এক দিন পর আমাদের লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
শহিদ কামরুলের বাবা বৃদ্ধ নান্নু মিয়া বলেন, ‘সচ্ছলতা ফেরাতে কামরুলের বিদেশ যাবার স্বপ্ন ছিল। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। কিন্তু তার আগেই তাকে পরপাড়ে পাড়ি জমাতে হয়েছে। আমার একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে এখন আমরা অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছি।’
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ছাত্র প্রতিনিধি বায়েজিদুর (সিয়াম) বলেন, ‘কামরুল মিয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন। কামরুল আমাদের গর্ব। পাশাপাশি জুলাই গণঅভুত্থানে তার ভূমিকাটি ছিল অনুপ্রেরণাময়।’
এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জেলার ২০ জন নিহতের একটি খসড়া তালিকা আমরা পেয়েছিলাম।
পরে যাচাই-বাছাই করা হয়। এর মধ্যে তালিকায় ১২ নম্বরে আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরের কামরুল মিয়া।’