শিরোনাম
প্রতিবেদন: রুপোকুর রহমান
সাভার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫(বাসস) : সন্ধ্যা খাতুন, বয়স ৩৫ বছর। অবুঝ দুই শিশু সন্তান নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। কারণ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে স্বামী মো. ফারুক শহিদ হয়েছেন। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন স্ত্রী।
মো. ফারুক (৫০)। গ্রামের বাড়ি জামালপুরের ডেঙ্গুয়ারজর নয়াপাড়া গ্রামে। বাবা মৃত হায়দার আলী এবং মা মৃত ফাতেমা বেগম। স্ত্রী সন্ধ্যা খাতুন আর ছেলে মাহফুজ (১২) এবং মেয়ে তাবাসসুমকে (৭) নিয়ে ছিল ছোট সংসার। উপার্জনের আশায় মো. ফারুক স্ত্রী আর সন্তানদের গ্রামের বাড়ি রেখে বছর দুয়েক আগে সাভারে আত্মীয়ের (বিয়াই) কাছে আসেন চাকুরির খোঁজে। সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ভাড়া থেকে একই এলাকায় আত্মীয় জনি মিয়ার মালিকানাধীন রাজ্জাক কাচাঁ বাজারে মুরগির দোকানের কর্মচারি হিসেবে কাজ শুরু করেন মো. ফারুক। কর্মস্থলের পাশে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে একাই থাকতেন তিনি। কাজ করে যা আয় হতো তা দিয়ে ভালোই চলছিল সংসার।
কিন্তু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে মো. ফারুক নিহত হলে পুরো পরিবারটি এলোমেলো হয়ে যায়। সাজানো-গোছানো সংসারে নেমে আসে শোকের ছায়া।
মো. ফারুক চার ভাই আর পাঁচ বোনের মধ্যে সবার বড়। ফরহাদ মিয়া, মুরাদ মিয়া, এবং মনোয়ার হোসেন নামের আরও তিন ভাই এবং হাফেজা বেগম, নাজমা আক্তার, মর্জিনা, হোসনে আরা এবং হাসিনা নামের আরও পাঁচ বোন রয়েছে তাঁর। মো. ফারুকের দাদা মৃত শুকুর শেখ এবং দাদি মৃত ইয়ারন বিবি। তার নানার নাম মৃত জসীম উদ্দিন এবং নানীর নাম মৃত জায়দা।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন চলাকালে ২০ জুলাই অন্যান্য দিনের মতোই মুরগির দোকানে বেচাকেনা করছিলেন মো. ফারুক। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই দুপুরের পর পর হঠাৎ একদল পুলিশ সদস্য এসে কাচাঁবাজারের মধ্যে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। এ সময় দোকান কর্মচারী মো. ফারুক মিয়া, তার আত্মীয় জনিসহ ৫ থেকে ৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়। এদের মধ্যে মো. ফারুকসহ আরও দু’জনকে আশংকাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন ২১ জুলাই রাতে মৃত্যুর কাছে হার মানেন ফারুক। পরে তার আত্মীয় জনি মিয়াসহ অন্যরা এসে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মো. ফারুকের মৃতদেহ তার গ্রামের বাড়ি জামালপুরের ডেঙ্গারজর নয়াপাড়া গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।
শহিদ মো. ফারুকের বিয়াই মো. জনি বাসস’কে মুঠোফোনে বলেন, দুই বছর হলো আমার আত্মীয় (বিয়াই) মো. ফারুক গ্রামের বাড়ি থেকে সাভারে আসেন। তখন তাকে আমি আমার মুরগির দোকানে কাজে লাগিয়ে দেই। বেশ ভালোই কাজ করছিল ফারুক। অনেক ভালো মনের মানুষ ছিল সে। কখনো কারও সাথে কিছু নিয়ে বিবাদে জড়ায়নি। অত্যন্ত বিনয়ী ফারুকের আশেপাশের সবার সাথেই ছিল সদ্ভাব। ২০ তারিখ দোকানে থাকা অবস্থায় পুলিশ এসে আমাদের বাজারে এলোপাথাড়ি গুলি করতে থাকে।
এসময় ফারুক, আমিসহ আরও বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হই। এদের মধ্যে ফারুক আর কোরবান শেখের অবস্থা আশংকাজনক ছিল। পরে তাদের উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২১ জুলাই রাতে মারা যায় ফারুক।
ঘাতক পুলিশের এমন নির্বিচারে গুলি করার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে জনি মিয়া বলেন, পুলিশ যে কতোটা হিংস্র হতে পারে তা সেদিন আমরা দেখেছিলাম। কোন কিছু বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎই বাজারে এসে সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে পুলিশ, যা ছিল ভয়ঙ্কর। আমরা তখন দ্বিবিদিক ছুটোছুটি করতে থাকি। তবুও পুলিশের গুলি থেকে আমরা রক্ষা পাইনি। তিনি এ সময় এসব ঘাতক পুলিশ সদস্যদের বিচার দাবি করেন।
শহিদ মো. ফারুকের ছেলে ৫ম শ্রেনিতে পড়ুয়া মাহফুজ আবেগতাড়িত কন্ঠে বাসস’কে মুঠোফোনে বলেন, ‘আমার বাবা ছিল অনেক ভালো মানুষ। আমাকে অনেক আদর করতো।
অনেক কিছু কিনে দিতো। আমাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যেত। বাবা নেই। এখন আমাকে আর কেউ ঘুরতে নিয়ে যায় না।’
সন্ধ্যা খাতুন বাসস’কে মুঠোফোনে বলেন, আমার স্বামীই ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার আয়েই চলতো আমাদের চারজনের সংসার। ফারুকের মৃত্যুর পর আমি চোখে মুখে অন্ধকার দেখছি। ছোট ছোট দুটি অবুঝ সন্তান রেখে চলে গেলে ফারুক। আমাদের কোন ব্যাংক ব্যালেন্স নেই। বাড়তি কোন আয়ের ব্যবস্থাও নেই।
এমন অবস্থায় এখন আমাদের সংসার কিভাবে চলবে?
সন্ধ্যা খাতুন আরো বলেন, ফারুকের মৃত্যুর পর আমরা সম্পূর্ণ একা হয়ে গেছি। সন্তানদের পুরোটা জীবন এখনো পড়ে রয়েছে। আমিও বা ওদের জন্য কি করতে পারবো?
দুই অবুঝ শিশু সন্তানের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে সন্ধ্যা খাতুন বলেন, আমার স্বামীকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে, নির্মমভাবে হত্যা করেছে, আমার সন্তানদের যারা এতিম করেছে আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
এদিকে বিএনপি’র পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা এবং একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শহিদের পরিবারটিকে ১ লাখ টাকা নগদ আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে।