বাসস
  ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৫:৫১

আন্দোলনে গিয়ে শহিদ হওয়ায় এমদাদুলের জানাজায় লোক সমাগমে বাধা স্থানীয় আওয়ামী নেতাদের

শহিদ মো: এমদাদুল হক - ছবি : বাসস

প্রতিবেদন:  মোঃ মিজানুর রহমান 

পিরোজপুর, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): এমদাদুল তার মাকে প্রায়ই বলতেন, মা আমার যেন শহীদি মৃত্যু হয় এবং আমি যেন তোমার আগে মারা যাই। আমার আগে তুমি মারা গেলে আমি সেই কষ্ট সহ্য করতে পারবো না। মাকে আরো বলতেন, মা চিন্তা করো না, আমাদের কোন অভাব থাকবে না। দেখো, আমাদের অনেক টাকা হবে।

এমদাদুল শহিদ হলেন, মায়ের আগে মারা গেলেন এবং মারা যাওয়ার পরে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা থেকে তার পরিবারের কাছে টাকাও আসতে লাগলো। এমদাদুলের সব চাওয়াকে যেন বিধাতা এভাবেই পূর্ণতা দিলেন।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র -জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে গত ২০ জুলাই ঢাকার উত্তর বাড্ডায় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন মো: এমদাদুল হক (২৭)। তিনি পেশায় ছিলেন একজন গাড়ি চালক। 

পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার ধাওয়া ইউনিয়নের, ধাওয়া গ্রামের রিকশা চালক আব্দুস সোবহান হাওলাদার ( ৫৬) ও হাসিনা বেগম (৫২) দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে মো: এমদাদুল হক ছিলেন সবার ছোট। তাদের অন্য দুই সন্তানের মধ্যে আয়েশা বেগম (৩৩) সবার বড় এবং মেজো সন্তানের নাম মোঃ হাসান হাওলাদার (৩১)। বড় দুই সন্তানের বিয়ে হলেও এমদাদুল ছিলেন অবিবাহিত। এইচএসসি পাশ করার পরে অভাবের সংসারে আর লেখাপড়া করতে পারেননি। নিজ এলাকায় কিছুদিন অটোরিকশা চালানোর পরে একটি কোম্পানিতে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি ড্রাইভিং শিখে গাড়ি চালানোর সনদ পেয়ে যান। অতঃপর ভাগ্যের অন্বেষণে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ঢাকাতে পাড়ি জমান। ঢাকায় গিয়ে প্রথমে পিকআপ ভ্যান চালানো শুরু করেন। কিন্তু এই পিকআপ ভ্যান চালানোটা মায়ের অপছন্দ হলে জুলাই মাসের ১ তারিখে একটি কোম্পানিতে প্রাইভেট কার চালকের চাকরি নেন। সেখান থেকে ১৫ দিনের বেতনও পেয়েছিলেন তিনি। 

সম্প্রতি ধাওয়া গ্রামে শহিদ এমদাদুলের বাড়িতে বসে বাসস’র এই প্রতিনিধির সাথে এসব নিয়ে কথা হয় তার পরিবারের সাথে।

এমদাদুলের মা হাসিনা বেগম বলেন, গত ১৯ জুলাই তাদের এলাকার সবাই বলাবলি করছিল আগামীকাল (২০ জুলাই) ঢাকায় অনেক গণ্ডগোল হবে। এই কথা শোনার পরে ঐদিন রাত ১০ টায় আমি আমার ছেলেকে ফোন দিয়ে বলি, বাবা আগামীকালকে নাকি ঢাকায় অনেক গণ্ডগোল হবে। তুমি রাস্তায় বের হবা না, আন্দোলনে যাবা না। ছেলে বলেছিল, তোমার এতো মায়া কেন? কত মায়ের ছেলেই তো রাস্তায় পড়ে আছে। বলেছিল আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না, কিছুই হবে না। তুমি অসুস্থ, আগামীকাল অবশ্যই ডাক্তার দেখাবা, যদি না দেখাও তাহলে আমার মুখ দেখবা না। ওটাই ছিল ছেলের সাথে আমার শেষ কথা। পরের দিন সকালে এই ভয়ে ছেলেকে ফোন করিনি...যদি আমার ফোন পেয়ে ছেলের ঘুম ভেঙ্গে যায় যায়। ছেলে আন্দোলনে যোগ দেয়।

তিনি বলেন, কিন্তু ছেলে আমার ঠিকই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। আমার ছেলে শহিদ হতে চেয়েছিল, আমার আগে মারা যেতে চেয়েছিল। ওর সব আশা আল্লাহপাক পূরণ করেছেন।

হাসিনা বেগম বলেন, ‘এমদাদুলের বন্ধু সজীবের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, ২০ জুলাই সকাল ৯ টার দিকে ঢাকার উত্তর বাড্ডায় আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশের একটি গুলি এসে লাগে আমার ছেলের কপালে। সাথে সাথে সে মাটিতে পড়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই নাকি আমার ছেলে মারা যায়।’

শহিদ এমদাদুলের ভাই হাসান চট্টগ্রামের একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন। তিনি বলেন, এমদাদুল শহিদ হওয়ার এক সপ্তাহ আগে বাড়িতে এসেছিল আমাদের মামাতো বোনের বিয়ে উপলক্ষে। তখন চট্টগ্রাম থেকে আমিও এসেছিলাম। সেই বিয়েতে আমরা অনেক আনন্দ করেছিলাম। কিন্তু বাড়ি থেকে ঢাকা যাওয়ার মাত্র ছয় দিন পরেই এমদাদুল শহিদ হন। গত ১৮ জুলাই ভাইয়ের সাথে আমার শেষ কথা হয়। সেদিন ভাইকে ফোন দিয়ে সাবধানে থাকতে বলেছিলাম, আন্দোলনে যোগ দিতে নিষেধ করেছিলাম।

এমদাদুলের বাবা আব্দুস সোবহান বাকরুদ্ধ। একদিকে ছেলে হারানোর শোক, অন্যদিকে তিনি শারীরিকভাবেও বেশ অসুস্থ। আগে অটো রিকশা চালাতেন, এখন তাও পারছেন না। 

তিনি বলেন, ছেলে আমার অনেক পরিশ্রমী ছিল। অনেক ভালো মানুষ ছিল। আমাদেরকে নিয়ে সবসময় চিন্তা করত। অনেক পরিশ্রম করে টাকা ইনকাম করে সেই টাকা বাড়িতে পাঠাতো। সেই টাকা দিয়ে আমরা চলতাম। 

এখন আমরা স্বামী স্ত্রী দুজনই অসুস্থ। ঔষধ কিনতে আমাদের অনেক টাকা লাগে। অভাবের সংসারে তিনি তার মেজো ছেলে হাসানের জন্য সরকারিভাবে একটি চাকরির দাবি জানিয়েছেন।

শহিদ এমদাদুলের মামা মো: জালাল মোল্লা বলেন, ২০ জুলাই সকাল সাড়ে নয়টায় এমদাদুলের বন্ধু সজীব প্রথমে আমাকে ফোন দিয়ে ঘটনা জানায়। আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশের গুলি লেগে এমদাদুল শহিদ হয়েছে। ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে। গুলি লাগার পর ওর বন্ধুরা মিলে ওকে উত্তর বাড্ডার এম জেড (প্রাইভেট) হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই সে মারা যায়। এর পরে সিরাজুল হক নামে এক আত্মীয়র মাধ্যমে এমদাদুলের মরদেহ ২০ জুলাই রাত তিনটায় বাড়িতে এসে পৌঁছায়। পরের দিন ২১ জুলাই সকালে স্থানীয় হাই স্কুল মাঠে জানাজার পরে পারিবারিক গোরস্থানে এমদাদুল হককে দাফন করা হয়।

তিনি আরো বলেন, সরকার বিরোধী আন্দোলনে গিয়ে এমদাদুল শহিদ হওয়ার কারণে জানাযার নামাজ যেন তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হয় এবং যেন বেশি লোক সমাগম হতে না পারে এজন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ থেকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিলাম।

প্রতিবেশী আলতাফ হোসেন ফরাজী বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে গিয়ে এমদাদুল শহিদ হয়েছেন। এটা আমাদের এলাকার জন্য গর্বের।

এদিকে  ইতোমধ্যে এমদাদুলের পরিবার জুলাই ফাউন্ডেশন, পিরোজপুর জেলা প্রশাসন, বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক অনুদান পেয়েছে। 

শহিদের মা হাসিনা বেগম এবং তার পরিবারের চাওয়া, এমদাদুলকে তারা আর ফিরে পাবেন না। কিন্তু তারা এমদাদুলের পরিপূর্ণ শহীদি মর্যাদা এবং অন্যায় ভাবে যারা তাকে মেরেছে তাদের বিচার দেখতে চান। পাশাপাশি প্রতিটি শহিদ পরিবারে একজনকে চাকরি দেওয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখতে চান।