বাসস
  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৫:১১
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৫:২২

কথা ছিল এনগেজমেন্টের, অথচ সেদিনই শহীদ মহিউদ্দিন গ্রামে ফিরলেন লাশ হয়ে

শহীদ মো. মহিউদ্দিন মহিন -ছবি : বাসস

 

প্রতিবেদন : আল-আমিন শাহরিয়ার

ভোলা, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫(বাসস) : মহিউদ্দিন মহিনের বাবা মারা গেছেন ১০ বছর আগে। বাবার মৃত্যুর ছয় বছরের মাথায় ২০২০ সালে মারা গেছেন মা। বাবা-মা’কে হারিয়ে মায়ের আদরে ঢাকায় বড় বোন লাইজু বেগমের কাছে থাকতেন মহিউদ্দিন। 

জেলা সদর ভোলার পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ চরপাতা গ্রামের মৃত হাসিম ওরফে কালু বয়াতীর ছেলে মো. মহিউদ্দিন মহিন (৩০)। ছয় ভাই তিন বোনের মধ্যে অষ্টম ছিলেন তিনি। বড় বোন লাইজু বেগমের বাসা ঢাকার মিরপুর রূপনগর আবাসিক এলাকার ২৭ নম্বর সড়কে। বিগত ১৬ থেকে ১৭ বছর ধরে বোনের কাছেই থাকতেন তিনি। ভগ্নিপতি আব্দুল মালেকের মুদি দোকানে কাজ করতেন। ভাই বোন সকলে বিয়ে করলেও তিনি বিয়ে করেননি। কথা ছিলো আগস্ট মাসের ৮ তারিখ গ্রামে এসে এনগেজমেন্ট করবেন। বাড়িতে থাকা বড় ভাইয়েরা ছোট ভাইয়ের জন্য মেয়েও ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু ঢাকায় ছাত্র জনতার আন্দোলনে পুলিশের ছোঁড়া ঘাতক বুলেটে সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। গত ৮ আগস্ট মহিউদ্দিন বাড়িতে এসেছেন ঠিকই। কিন্তু এনগেজমেন্টের পরিবর্তে হয়েছে তার দাফন।

আদরের ভাইকে হারিয়ে বুকফাটা আর্তচিৎকার দিয়ে বোন লাইজু বেগম বলেন, ভাইয়ের মৃত্যুর কথা এখনো মনে হলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। গত প্রায় ১৬-১৭ বছর এ ভাইকে অনেক আদর যত্ম করে বড় করেছি। ভাইকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আশা ছিলো। নিমেষেই সব আশা শেষ হয়ে গেছে। 

তিনি জানান, বাবা ও মা হারা ছোট ভাই মহিউদ্দিন মহিন বিগত ১৬/১৭ বছর ঢাকায় তার কাছেই থাকতেন। তিনি ভাইকে মায়ের আদরে বড় করেছেন। তার স্বামীর মুদি দোকান মহিউদ্দিনই পরিচালনা করতেন। গত ৫ আগস্ট সকালে বাসা থেকে নাস্তা করে দোকানে যায় সে। দুপুর ১২টার দিকে পুনরায় দোকান থেকে বাসায় আসে। আবারো দুপুর ১টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় তাকে খাবার খাওয়ার জন্য বললে সে বলে, পরে এসে খাবে। 

তাকে আন্দালনে যেতে নিষেধ করলেও সে শোনেনি। এরপর তার সাথের লোকজনের সঙ্গে মিরপুর-২ নম্বরে যায়। 

বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে সাথের লোকজন ফোন করে জানায়, মহিউদ্দিনের বুকে গুলি লেগেছে। এ খবর পেয়ে তারা দ্রুত হাসপাতালে ছুটে যান। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি জানান, সেখানে গিয়ে শোনেন মিরপুর-২ নম্বরে থানার সামনে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় বুকে গুলি লাগে। সে গুলি খাদ্যনালী ফুটো করে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায় এবং মহিউদ্দিন মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ সময় সাথের লোকজন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে তার অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেদিন রাতেই তার খাদ্যনালীতে অস্ত্রোপচার করা হয়। সেখানে আইসিইউ না পেয়ে শ্যামলী সিটি কেয়ার হাসপাতালে নিতে হয় মহিউদ্দিনকে। 

পরে সেখানে দুই দিন পর ৮ তারিখ সন্ধ্যা ৬টার দিকে মারা যান মহিউদ্দিন মহিন। এই তিন দিনে তাদের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। শুধু আইসিইউর বিল হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার। আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে হাসপাতাল থেকে মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।

শহীদ মো. মহিউদ্দিন মহিন -ছবি : বাসস

শহীদ মহিউদ্দিনের বড় ভাই আলমগীর জানান, তাদের ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে মহিউদ্দিনই এসএসসি পাশ করেছে। এরপর ঢাকায় বোন লাইজুর কাছে চলে যায় সে। অভাবের কারণে আর পড়ালেখা করাতে পারিনি। 

ভাইদের মধ্যে সবাই পারিবারিকভাবে অসচ্ছল। বাবা মারা যাওয়ার পর যে যার মতো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ছোট দুই ভাই মহিউদ্দিন ও মনজু গ্রামের বাড়িতে এক সাথে একটি ঘর করেছেন। 

তিনি আরো জানান, মহিউদ্দিন বিভিন্ন সময় বাড়িতে আসলে বড় ভাইদের টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করতেন। 

ঈদের সময়ও ভাইদের নতুন জামা-কাপড় দিতেন। ছোট ভাই মনজু বিয়ে করলেও মহিউদ্দিন করেনি। কথা ছিলো আগস্টের ৮ তারিখ বাড়িতে এসে মেয়ে দেখে এনগেজমেন্ট করে যাবে। আর ডিসেম্বরে বিয়ে করবে। মারা যাওয়ার ৪-৫ দিন আগেও মোবাইলে কথা হয়েছে। কিন্তু ৫ আগস্ট খবর আসে মহিউদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরে ৮ আগস্ট সন্ধ্যায় শ্যামলী সিটি কেয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে। পরদিন জুমার নামাজের পর জানাযা শেষে তাকে গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তিনি ভাই হত্যার বিচার দাবি করেন। 

বোন লাইজু বেগম জানান, ভোলা জেলা জামায়াতে ইসলামী এবং ভোলার জেলা প্রশাসক থেকে তারা অনুদান পেয়েছেন।