শিরোনাম
প্রতিবেদন : রুপোকুর রহমান
সাভার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : উচ্চ শিক্ষার জন্য আর মালয়েশিয়া ফিরে যাওয়া হলো না সাভারের মেধাবী শিক্ষার্থী শ্রাবণ গাজীর (২২)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঘাতকের বুলেট তাকে নিস্তব্ধ করে দেয়। শহীদ হন শ্রাবণ গাজী। সেই সাথে ধুলিসাৎ হয়ে যায় পুরো পরিবারের স্বপ্ন। সদা হাস্যেজ্বল আর মেধাবী সন্তান হারানোর শোকে মুহ্যমান বাবা-মা আর একমাত্র ছোট বোন।
সাভারের ডেইরি ফার্মের সন্দীপ গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা মান্নান গাজীর (৪৭) বড় ছেলে শ্রাবণ গাজী। মা শাহনাজ বেগম (৪০) গৃহিনী। একমাত্র ছোট বোন মহিমা ইলাহী (১১) পড়ছে ক্লা ফোরে। দাদা মৃত নেওয়াজ গাজী ও দাদী মৃত ফুলজান বেগম। নানার নাম ফজল হক (৭০) ও নানী মৃত কোরবান নেছা।
শ্রাবণ গাজী উচ্চ শিক্ষার জন্য ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে টুংকো আব্দুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অনার্সে ভর্তি হয়ে মালয়েশিয়া চলে যায়। জুলাইয়ের ১৬ তারিখ ছুটিতে দেশে আসে সে। দেশে এসেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বন্ধুদের সাথে যোগ দেয়। প্রায় প্রতিদিনই চলমান আন্দোলনে বন্ধুদের সাথে যোগ দিতো শ্রাবণ। ৫ আগস্ট সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডস্থ নিউমার্কেটের সামনে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। স্থানীয়দের সহায়তায় সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে নেওয়া হলে শ্রাবণ সেখানে মারা যায়।
শহীদ শ্রাবণ গাজীর বাবা মান্নান গাজী বাসস’কে জানান, শ্রাবন ছোট বেলা থেকেই ছিল অত্যন্ত মেধাবী। কখনো ওকে পড়াশোনার কথা বলা লাগেনি।
এসএসসি ও এইচএসসি’র রেজাল্টও অনেক ভালো করে ও। কিন্তু পরবর্তীতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেয়ে মালয়েশিয়ায় গিয়ে পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নেয়। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমারাও আর দ্বিমত করিনি। ২০২৪ সালের জানুয়ারী মাসে ও মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। পরে সেখানে টুনকো আব্দুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অনার্সে ভর্তি হয়। পড়াশোনাও ভালোই চলছিল।
মান্নান গাজী বলেন, দেশে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হলে শ্রাবন প্রায়ই আমাদের কাছ থেকে খবর নিতো। ওর বন্ধুদের সাথেও ওর যোগাযোগ ছিল। ১৬ জুলাই শ্রাবন দেশে চলে আসে। কয়েকদিন দেশে থেকে আবার মালয়েশিয়ায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিল শ্রাবনের। কিন্তু স্বৈরাচারের দোসরদের গুলিতে আমার শ্রাবনের সে স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। আমাদের পুরো পরিবারই আজ শ্রাবনের মৃত্যুতে দিশেহারা। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আমরা সবাই পাগলপ্রায়।
মান্নান গাজী আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, দেশে আসার পর থেকেই ও ওর বন্ধুদের সাথে আন্দোলনে অংশ নেয় যা পরবর্তীতে আমি বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি। ৫ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে অংশ নিতে সকাল শ্রাবণ ১০টা ৪০ মিনিটে বাসা থেকে বের হয়। আমি দুপুরের নামাজ পড়ে পাশের একটি দোকানে বসে টিভি দেখছিলাম। টিভিতে তখন স্বৈরাচার সরকারের পতনের খবর দেখাচ্ছিল। দুপুর তখন আড়াইটা হবে, এমন সময় আমার মোবাইল ফোনে কেউ একজন ফোন দিয়ে বলে আপনাদের শ্রাবণ কই। তখন আমার বুকের ভিতর কেঁপে উঠে। আমি তখন মোবাইল ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ওই ব্যক্তিকে বলি, এই যে, আপনি কে? আমার শ্রাবণের কী হয়েছে?
‘ওই ব্যক্তি আমাকে বলে আপনাদের শ্রাবণ গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আপনারা দ্রুত সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে চলে আসুন। তখন আমি দ্বিগবিদিক ছুটোছুটি করতে থাকি। রাস্তাঘাটের অবস্থা তখনও স্বাভাবিক হয়নি। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিভিন্নস্থানে তখন পুলিশ। যান চলাচল বন্ধ। পুরো সাভার জুড়ে তখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিভিন্ন দিক থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসছে। এমন অবস্থায় আমি সিএন্ডবি হয়ে আশুলিয়ার আড়াগাঁও দিয়ে অনেকটা পথ ঘুরে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে গিয়ে পৌছাই। ততক্ষণে সব শেষ।’
মান্নান গাজী বলেন, ‘আমি দেখি আমার ছেলে শ্রাবণ গাজীর মৃতদেহ হাসপাতালের স্ট্রেচারে পড়ে রয়েছে। বুকের মানিক একমাত্র ছেলেকে ওই অবস্থায় দেখে আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। পড়ে ছেলের মৃতদেহ বাড়ি নিয়ে গিয়ে যাই। আমার ছেলে অনেক ভালো ছিল। সবাই ওকে আদর করত। সবার সাথেই সুহৃদ সম্পর্ক ছিল শ্রাবণের। ওর এমন মৃত্যুতে আমাদের গোটা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। ওর মৃতুতে সকলেই শোক প্রকাশ করে। পরে সাভার ডেইরি ফার্ম কবরস্থানে দাফন করা হয় শহীদ শ্রাবণ গাজীর লাশ।’
মান্নান গাজী এসময় তার ছেলের হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। শহীদ শ্রাবণ গাজীর মা শাহনাজ বেগম বলেন, বর্তমান সমাজে আমার ছেলের মতো ছেলে পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। যথেষ্ট ভালো ছিলো আমাদের ছেলেটা। খুনিরা আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে।
শ্রাবণ গাজী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের তিনি দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন।
শ্রাবণ গাজীর পরিবারের সদস্যরা এ পর্যন্ত জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ৫ লাখ টাকা, বিএনপি থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন।