বাসস
  ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৭:৪৩

তিন শিশু সন্তান নিয়ে অসহায় শহীদ আলী হোসেনের স্ত্রী খায়রুন্নেছা

শহীদ আলী হোসেন - ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : মো. জিয়াউর রহমান

নেত্রকোনা, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): ঋণের টাকা পরিশোধ করতে ছোট ছোট তিন শিশুকন্যাকে গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ মায়ের কাছে রেখে বছরখানেক আগে ঢাকায় গিয়েছিলেন আলী হোসেন (৪৫)। সাথে নিয়ে নিয়েছিলেন স্ত্রী খায়রুন্নেছাকেও (৩৫)। 

ঢাকার উত্তরা মুন্সি মার্কেটের একটি ভাড়া বাসায় থেকে রাস্তার পাশে বসে পান-সিগারেট বিক্রি করতেন আলী হোসেন। আর তার স্ত্রী খায়রুন্নেছা কাজ করতেন মানুষের বাসা-বাড়িতে। এভাবেই কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে প্রতি মাসেই গ্রামে টাকা পাঠিয়ে ঋণ পরিশোধ করতেন এবং পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। 

কিন্তু গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার দুপুরে উত্তরা এলাকায়  বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন পান বিক্রেতা আলী হোসেন। তার মৃত্যুতে তিন কন্যাশিশুসহ পরিবারের লোকজন নির্বাক। হতবাক এলাকাবাসীও। নিহত আলী হোসেনের তিন কন্যা সন্তান সাদিয়া আক্তার (১৪), মাহিবা আক্তার (৬) ও মারিয়া আক্তার (৩)কে সান্তনা দেওয়ার যেন ভাষা নেই কারোরই।

নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার মোজাফরপুর ইউনিয়নের মোজাফরপুর (পশ্চিমপাড়া) গ্রামের মৃত আসন আলীর ছেলে আলী হোসেন। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের ভরণপোষণের ভার পড়ে আলী হোসেনের কাঁধে।

পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, আলী হোসেনের পরিবারে বৃদ্ধ মা বেদেনা আক্তার, ছোট ভাই আবু বক্কর, স্ত্রী খায়রুন্নেছা ও তিন কন্যাশিশু রয়েছে। আলী হোসেন পরিবারটির সার্বিক দেখভাল করতেন। সহায় সম্পদ বলতে বসতভিটাটুকু ছাড়া আর কিছুই নেই। বৃদ্ধ মা প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। ছোট ভাই আবু বক্করও শ্বাসকষ্টের রোগী। 

এ অবস্থায় গ্রামের বাজারে কাঁচামালের ব্যবসা করে কোনোরকম সংসার চালিয়ে আসছিলেন আলী হোসেন। এতে বেশ কয়েক লাখ টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য তিন কন্যাসন্তানকে বৃদ্ধ মায়ের কাছে রেখে বছরখানেক আগে সস্ত্রীক ঢাকায় চলে যান আলী হোসেন। 

ঢাকায় উত্তরা মুন্সি মার্কেটের একটি ভাড়া বাসায় থেকে উত্তরা-আজমপুর রেলস্টেশন এলাকায় রাস্তার পাশে বসে পান-সিগারেটের ব্যবসা করতেন আলী হোসেন এবং স্ত্রী খায়রুন্নেছা মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করতেন।

খায়রুন্নেছা জানান, গত ১৮ জুলাই সকাল আটটার দিকে পান্তা ভাত খেয়ে দোকান নিয়ে বের হন স্বামী আলী হোসেন এবং তিনিও কাজে চলে যান। পরে দুপুরে বাসায় খেতে গিয়ে দেখেন স্বামী আসেনি। অথচ প্রতিদিনই তিনি দুপুরে বাসায় খেতে আসেন। একপর্যায়ে স্বামীর খুঁজে বাসা থেকে বেরিয়ে যান খায়রুন্নেছা। 

যেখানে স্বামী নিয়মিত দোকান নিয়ে বসতেন সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, দোকানটি পাশের একজনের কাছে রেখে আলী হোসেন সামনে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুই তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও ফিরে আসেননি। পরে স্থানীয় কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে আলী হোসেনের মরদেহ পড়ে থাকার খবর পান।

তার স্বামী একজন সহজ সরল সাধারণ মানুষ ছিলেন জানিয়ে খায়রুন্নেছা বলেন, আমার সব শেষ হয়ে গেল। ছোট ছোট তিনটি অসহায় মেয়ে সন্তান নিয়ে বর্তমানে চরম অসহায় অবস্থায় জীবন যাপন করছি। সামনের দিনগুলো কিভাবে চলব- বুঝতে পারছি না। কে দেখবে আমাদের?

কাঁদতে কাঁদতে বড় মেয়ে সাদিয়া আক্তার বলেন, বাবাই ছিল আমাদের সব। বাবাকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমরা এর বিচার চাই। আল্লাহ যেন খুনিদের সঠিক বিচার করেন।

নিহত আলী হোসেনের বৃদ্ধ মা যেন পুত্রশোকে নির্বাক। তিনি মৃদুকণ্ঠে বলেন, এভাবে ছেলের মৃত্যু হলে মায়ের যে কেমন লাগে- তা বুঝাতে পারব না। আমার এমন সর্বনাশ কেন হলো? আমার অবুঝ নাতনিগুলোকে এখন কে দেখবে?

আলী হোসেনের ছোট ভাই অসুস্থ আবু বক্কর বলেন, আমার ভাই-ই ছিল আমাদের সব। তিনি নিজে কষ্ট করলেও আমাদের সুখের কথা ভাবতেন। এখন আর আমাদের নিয়ে ভাববার মানুষটি রইল না। যে ঋণ পরিশোধ করতে ঢাকায় গিয়েছিলেন, তা সব এখনও শোধ করা হয়নি। তাছাড়া ভাইয়ের স্ত্রী, ছোট তিনটি মেয়ে, বৃদ্ধ মা- এদেরকে কে দেখবে? আমি অসুস্থ মানুষ। কিছুই করতে পারি না। আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর সহায় রইল না।

স্থানীয়রা জানান, আলী হোসেন ছিলেন খুবই সাদামাটা ও কর্মঠ একজন মানুষ। তিনি কোনো দলের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। কখনও কাঁচামালের ব্যবসা, কখনও চট্টগ্রাম আবার কখনও ঢাকায় পান-সিগারেট বিক্রি করে সাধারণ জীবনযাপন করে আসছিলেন। তাই পুলিশের গুলিতে এমন একজন সহজ সরল মানুষের মৃত্যুতে এলাকার লোকজন শোকাহত বলে জানান তারা।

এ বিষয়ে স্থানীয় মোজাফফরপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাকির আলম ভূইয়া বলেন, আলী হোসেনের মৃত্যুর ঘটনাটি আমাদেরকে ব্যথিত করেছে।

তিনি ছিলেন খুব সাধারণ খেটে খাওয়া একজন মানুষ। তার মৃত্যুতে পরিবারটি খুব অসহায় হয়ে পড়েছে। আমরা আলী হোসেনের স্ত্রী-সন্তানদের পাশে আছি এবং থাকব।

তবে পরিবারটিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই সরকারি সহায়তা জরুরি।