শিরোনাম
প্রতিবেদন : বাবুল আখতার রানা
নওগাঁ, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (বাসস) : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ঢাকার বাইপেলে নওগাঁর বিপ্লব মণ্ডল (৩৩) গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। বিপ্লব মণ্ডল নওগাঁ সদর উপজেলার শিমুলিয়া মণ্ডলপাড়া গ্রামের লুৎফর মণ্ডলের ছেলে। শহীদ বিপ্লব ঢাকার বাইপেল এলাকায় একটি সেলুনে কাজ করতেন।
শহীদ বিপ্লবের বাবা লুৎফর মণ্ডল বাসস’কে বলেন, গত ৪ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে বিপ্লব তার ছোট ভাই ফিরোজকে ফোনে না পেয়ে ফোন দেয় আমাকে। বলে, 'আব্বা তুমি গ্রামের বাহিরে কাজ করতে যেও না। ছোট ভাইকেও কাজে যেতে দিও না। তোমরা সাবধানে থেকো। কেউ ডাকলে যাবে না। দেশের অবস্থা ভালো না। ঢাকায় চরম গণ্ডগোল হচ্ছে। আমার জন্য চিন্তা করো না। বাবা তুমি মা ও ছোট ভাইকে দেখে রেখ। তাদের যেন কিছু না হয়।'
শহীদ বিপ্লবের বাবা লুৎফর মণ্ডল বাসস’কে আরও বলেন, এরপর ৫ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি ঢাকায় ব্যাপক গণ্ডগোল হচ্ছে। কিছু ভালো লাগছে না। জোহরের নামাজের আগে ফোন দিলাম। ফোন বন্ধ। তখন বউ-মাকে ফোন দিলাম, তখন বউ মা বললো; ‘মনে হয় আপনার ছেলে দোকানে গেছে।’
বউ মা-কে বললাম, ‘বিপ্লব কি আন্দোলনে গেছে?’ উত্তরে বলে; ‘সব কথা তো আমাকে বলে না বাবা।’ চিন্তা আরও বেড়ে গেল। তখন জোহরের নামাজের সময় হয়ে এসেছে। বিপ্লবের মাকে বললাম, ‘ভাত দাও। ভাত খেয়ে নামাজে যাব।’ তখন মনটা ছটফট করছে। ভাত না খেয়ে বড় মেয়ে মিমিকে ফোন দিলাম। মিমি বললো, ‘আমি ভাইয়ের বাসাতে গিয়ে তোমারে বলছি।’
বিপ্লবের মাকে বললাম, ‘আগে ছেলের সাথে কথা বলব, তারপর ভাত খাব।’ অনেকক্ষণ পর মিমি বললো, ‘আব্বা, তোমার ছেলের ফোন বন্ধ। পাওয়া যাচ্ছে না। তার বন্ধুরা বললো, বিপ্লব ভাইকে গুলি করেছে খুনি হাসিনা।’ তখন আমি মিমিকে বললাম, ‘তোর ভাই এর লাশের খোঁজ কর মা। মেডিকেলে খোঁজ কর, লাশ পাওয়া যাবে না কি খুনি হাসিনা হাজার হাজার লাশ একত্র করে গণকবর দিয়েছে।’ সবাই খোঁজাখুজি করেও তখন বিপ্লবের লাশের খবর কেউ দিতে পারেনি।
শহীদ বিপ্লবের বাবা লুৎফর মণ্ডল বাসস’কে আরও বলেন, পরদিন ৬ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে শেখ ফজিলাতুননেছা মেডিকেলে বিপ্লবের লাশের খোঁজ পাওয়া যায়।’ বলতে বলতে হাউ-মাউ করে কাঁদতে থাকেন লুৎফর মণ্ডল। ‘তবে হাসপাতাল থেকে লাশ আনা মুশকিল ছিল। তারা লাশ দিতে চাচ্ছিল না। হাসপাতালের লোকজন বলেছে লাশের কোন কাগজ দিবে না। জোর করে মোবাইলে ছবি তোলা হয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেল, কিন্তু ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। হাসপাতাল দিল মাত্র ৫ হাজার টাকা। অনেক কষ্ট করে লাশ আসরের নামাজের ১৫-২০ মিনিট আগে বাড়িতে নিয়ে এসে দাফন করি। পরে অনেক কষ্ট করে বাকি ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছি।
ওই গ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবিএম এনামুল হক বকুল বাসস’কে বলেন, বিপ্লবের পরিবার অসহায়। তার বাবা আগে ভ্যান চালাত। এখন অন্যের জমি ও বাড়িতে কাজ করে কোনো রকম সংসার চালায়। যে ছেলে মারা গেছে, তার আয় দিয়ে সংসার চলতো লুৎফরের। ছেলে মারা যাবার পর সে আয় বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবারের জন্য সরকারের পক্ষে যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকুরির ব্যবস্থা ও শহীদ বিপ্লবের ৯ বছরের শিশুর জন্য পড়ালেখার খরচ চালানোর দাবি জানান তিনি। ইতোমধ্যে তার পরিবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছে।
প্রতিবেশী গোলাম হোসেন বাসস’কে বলেন, ‘হাসিনা সরকার নয়; সরকার নামে কলংক। যারা অসংখ্য মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে। তারা এই সুন্দর বাংলাদেশটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’ তবে এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আকুল আবেদন খুনি ও জালিম হাসিনাকে ভারতে থেকে ধরে নিয়ে এসে বিচার করতে হবে।
শহীদ বিপ্লব মণ্ডলের মা বিলকিস বেগম বাসস’কে বলেন, ‘আমার চার ছেলে-মেয়ে। এর মধ্যে বিপ্লব দ্বিতীয়। সবার বড় মিমি, এরপর ফিরোজ আর সবার ছোট বৃষ্টি। বিপ্লবের জন্ম ১৯৯১ সালের ৮ জুলাই। ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। সংসারের অভাবের কারণে আর লেখাপড়া করতে পারেনি।
বাড়ির পাশে মাদারমোল্লায় সেলুনের কাজ করতো। তার উপার্জনের টাকা দিয়ে চলত সংসার। আজ থেকে ১০ বছর আগে একই গ্রামের আরিফার সাথে বিয়ে দেয়া হয়। এরপর ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তান আসে তার ঘরে। আস্তে আস্তে সংসারের অভাব বেড়ে যাওয়ায় সেলুনের কাজ করতে ঢাকায় যায় ৪ বছর আগে। গত ৪ আগস্ট রাতে বিপ্লব তার বাবাকে ফোন দেয়। অল্প কথা হয় আমার সাথে। বলল, ‘আব্বার বয়স অনেক হয়েছে। দেখে রেখ মা।’
তিনি আরো বলেন, ‘খুনি হাসিনা আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। খুনি হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে আমরা ঘৃণা করি। কারণ এই দল শত শত মানুষকে গুলি করে শেষ করে দিয়েছে। অনেকের লাশ গুম করে ফেলেছে। আমরা এই খুনি হাসিনার বিচারের দাবি করছি।’
শহীদ বিপ্লবের স্ত্রী আরিফা বেগম বাসস’কে বলেন, ‘বাড়িতে বসে সময় না কাটায় বিপ্লবের সেলুনের পাশাপাশি তিনি গার্মেন্ট-এ জুট মিলে চাকুরি করতেন। আমি ভোরে কাজে যাই আর সে সকাল ১০টায় দোকানে যায়। ঘটনার দিন আমার অফিস খোলা ছিল। আমি বাসায় থাকতেই বড় আপা মিমিকে ফোন দিয়ে বলে, ‘আপা, আমার বাসায় আস, আমিনা (বিপ্লবের মেয়ে) একা থাকবে।’
সে প্রতিদিন দোকান বন্ধ রেখে আন্দোলনে যেত, এটা আমি পরে জানতে পেরেছি। তার বন্ধুরা দুপুরে বাসায় এসে বলে, ‘বিপ্লবকে গুলি করে মেরে ফেলেছে খুনি হাসিনা।’
শহীদ বিপ্লবের স্ত্রী আরিফা বেগম বাসস’কে আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নয় লাখ টাকার মতো সাহায্য পেয়েছি। তবে আমার মেয়ে ছোট। সরকারের পক্ষ থেকে যদি আমার মেয়েকে লেখাপড়া করাত, তাহলে অনেক ভালো হতো। মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টে আছি।’
শহীদ বিপ্লবের ৯ বছরের মেয়ে আমিনা বাসস’কে বলে, 'বাবা সকালে দোকানে যাবার সময় বলেছিল, আমার জন্য দুপুরে চকলেট নিয়ে আসবে। আর দুপুরে আমরা সবাই একসাথে ভাত খাবে। বাবা আর ফিরে আসলো না।’ বলতে বলতে ‘বাবা, বাবা’ বলে হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠে মেয়েটি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্র প্রতিনিধি নওগাঁ সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অর্নাস ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী রতন হাসান বাসস’কে বলেন, ‘ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মাহিন সরকারসহ ২১জন এসেছিল নওগাঁয়। তারা বিপ্লব ভাইয়ের কবর জিয়ারত করেছে। আর নগদ কিছু অর্থ সহায়তা দিয়েছে। এদিকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা চেক প্রদান করা হয়েছে। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম রাজশাহী শিল্পকলা একাডেমিতে এ টাকা প্রদান করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধারা যেমন প্রতি মাসে টাকা পায়, ঠিক তেমনটি দেশের সকল শহীদ পরিবারগুলোতে প্রতি মাসে ভাতা প্রদানের জোর দাবি জানাই।’
নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বাসস’কে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারগুলোকে গত ১৯ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে ২ লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।