বাসস
  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫৪

ফ্যাসিবাদী শাসন অবসানে শহীদ হন পারভেজ

শহীদ পারভেজ হাওলাদার -ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : সৈয়দ এলতেফাত হোসেন

সিদ্ধিরগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ), ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (বাসস): একটি গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহের দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন ২৫ বছর বয়সী তরুণ পারভেজ হাওলাদার। ২০২৪-এর ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ঐতিহাসিক ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি নিয়ে সম্ভাব্য বিপদের কথা আগেই পরিবারকে সতর্ক করেছিলেন তিনি। কিন্তু ১৬ বছর ধরে চলা স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটানোর দৃঢ় প্রত্যয়ে পারভেজ নিজেই সেই উদ্বেগ উপেক্ষা করে মিছিলে যোগ দেন।

এই আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরাচারকে উৎখাত করতে সক্ষম হলেও পারভেজ কখনোই বাড়ি ফেরেননি, যুদ্ধ করা লক্ষ্যের বিজয় দেখেও যাননি। রাজধানীর শাহবাগে পৌঁছাতে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টাকালে যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি শহীদ হন। একটি গুলি তার বাম গাল ভেদ করে মাথার পিছন দিয়ে বেরিয়ে যায়।

পারভেজের বড় বোন সেলিনা তার মৃত্যুর আগের রাতের শেষ কথোপকথন স্মরণ করে বলেন, ‘তোমরা শুরু থেকেই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছ, আমি কখনও বাধা দিইনি।

কিন্তু কাল আন্দোলনে যেও না। পুলিশ বৃষ্টির মতো গুলি চালাবে।’ পারভেজের পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় সেলিনা এ কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। সিদ্ধিরগঞ্জের নিমাই কাসারি বাজারে তাদের ভাড়া বাসায় বসে ছোট ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার চোখ জলে ছলছল হয়ে ওঠে।

সেলিনা জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু থেকেই পরিবারের সবার সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন পারভেজ। কিন্তু ‘রাস্তায় ছাত্রদের কান্না আমরা সহ্য করতে পারিনি। তাই ভাই-বোন, শিশু-সবাই মিলে আন্দোলনে শরিক হয়েছি,’ বলেন তিনি। 

পারভেজের উদ্বেগের কথা তুলে ধরে সেলিনা বলেন, ‘সে আমাকে বলে, 'কাল যদি তুমি আন্দোলনে গিয়ে মারা যাও, তাও ভালো। কিন্তু যদি পঙ্গু হয়ে যাও, তাহলে অন্যের বোঝা হয়ে যাবে। তেমনি তোমার মেয়ে যদি পঙ্গু হয়, তার বিয়ে দিতে পারবে না।’ তখন সেলিনাও তাকে পরদিন আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেন।

কিন্তু ৫ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে নাশতা করতে বেরোনোর কথা বলে বাড়ি ছাড়েন পারভেজ। সেলিনা বলেন, ‘সকাল ১০টার দিকে ভাই ফোন করে বলল, রাস্তায় ভয়াবহ পরিস্থিতি, সবার জন্য দোয়া চাই। আমাদের বাইরে না যেতে বলল।' দুঃখভরা কণ্ঠে তিনি যোগ করেন, 'কিন্তু দুই ঘণ্টা পর তার বন্ধু মোহসিন আমাদের বাড়িতে এসে ভয়াবহ খবর দেয়—পারভেজ গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তাকে রাজধানীর শনির আখড়ার সালমান হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।’

সেলিনা হাসপাতালে ছুটতে গিয়ে পারভেজের এক বন্ধুর ফোন পেয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। ‘বাড়ি ফিরে দেখি, ভাইয়ের নিথর দেহ একটি রিকশা ভ্যানে করে আমাদের বাড়ির সামনে আনা হয়েছে,’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে সেলিনা সেই মর্মান্তিক মুহূর্তের কথা বললেন। ওই দিন আসরের নামাজের পর স্থানীয় গোরস্থানে পারভেজকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।

পারভেজ ও তার মা হাসি বেগম সেলিনার পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। তার বড় ভাই ফয়সাল হাওলাদার (মাছ ব্যবসায়ী), বড় বোন হালিমা ও রোকসানা একই বিল্ডিংয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। জমি ও বাড়িহীন এই পরিবার কয়েক দশক আগে মুন্সিগঞ্জ সদর থেকে সিদ্ধিরগঞ্জে এসে ভাড়া বাড়িতে থাকেন।

সদয় হৃদয়ের জন্য পরিচিত পারভেজ সর্বদা মানুষের সাহায্যে এগিয়ে যেতেন। কিন্তু ন্যায়ের লড়াইয়ে তার জীবন অকালে শেষ হয়। তার মৃত্যু এলাকাজুড়ে শোকের ছায়া ফেলে। এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয়রা পারভেজের নামে একটি সড়কের নামকরণ করেছে। নিমাই কাসারি বাজারে তার ছবি ও সংক্ষিপ্ত জীবনী সম্বলিত একটি ব্যানার টাঙানো আছে।

সেলিনা বলেন, ‘আমার ভাই ছিলেন পরোপকারী। তিনি অন্যকে সাহায্য করতেন।’ পারভেজ বিদেশে গিয়ে কাজ করে পরিবারের ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখতেন বলে জানান তিনি। 

শহীদ ছেলে সম্পর্কে কথা বলতে বলা হলে ৬৩ বছর বয়সী মা হাসি বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। ‘আমার ছেলে আমার দেখভাল করত। আমার যেন কোনো কষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখত,’ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলেন তিনি। 

পারভেজের বাবা মজিবুর হাওলাদার ১৪ মাস আগে মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর মাকে মক্কায় হজে পাঠানোর স্বপ্ন দেখতেন পারভেজ। ‘আমার ছেলে আমাকে হজে পাঠানোর স্বপ্ন দেখত। কিন্তু শেখ হাসিনা সব ধ্বংস করে দিলো,’ বলেন হাসি বেগম। 

পারভেজের পরিবার তার হত্যার বিচার দাবি করেছে। তার মা হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছেন।